আজ থেকে মিশন বিশ্বকাপ

নেটেই ক্যাপ্টেন কুল বুঝিয়ে দিচ্ছেন দল কতটা গনগনে

মাইন্ড দ্য বল! উইলোর কষাঘাত সৃষ্ট এক-একটা কানফাটানো আওয়াজ, আর তাকে ঘিরে ভারতীয় সাপোর্ট স্টাফ টিমের তীব্র চিৎকার। চিৎকার বলাটা একটু ভুল হল। আদতে ওটা জামথা স্টেডিয়ামের ফোটোগ্রাফারদের প্রতি সতর্কতাবাণী। পাঁচটা বাজে। আর একটু পর ভারতীয় টিমের প্র্যাকটিস সেশন শেষ হবে। কিন্তু গ্যালারির ফাঁকা চেয়ারে খটাস-খটাস শব্দে বলগুলোর আছড়ে পড়া এখনও থামল না।

Advertisement

রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়

নাগপুর শেষ আপডেট: ১৫ মার্চ ২০১৬ ০৪:৩৩
Share:

কাপ এখন ‘মাছের চোখ’। নাগপুরে সোমবারের ধোনি।

মাইন্ড দ্য বল!

Advertisement

উইলোর কষাঘাত সৃষ্ট এক-একটা কানফাটানো আওয়াজ, আর তাকে ঘিরে ভারতীয় সাপোর্ট স্টাফ টিমের তীব্র চিৎকার। চিৎকার বলাটা একটু ভুল হল। আদতে ওটা জামথা স্টেডিয়ামের ফোটোগ্রাফারদের প্রতি সতর্কতাবাণী। পাঁচটা বাজে। আর একটু পর ভারতীয় টিমের প্র্যাকটিস সেশন শেষ হবে। কিন্তু গ্যালারির ফাঁকা চেয়ারে খটাস-খটাস শব্দে বলগুলোর আছড়ে পড়া এখনও থামল না। ভারতীয় টিমের সঙ্গে সর্বত্র সুধীর গৌতম নামের যে সমর্থককে ঘুরতে দেখা যায়, তাঁর মাথায় পাঁচ ইঞ্চি উপর দিয়ে একটা উড়ে গেল। আশিস নেহরাকে এমন একটা মারলেন যে, সোজা সেটা প্রেসবক্স ছাড়িয়ে-টাড়িয়ে স্টেডিয়ামের আপার টিয়ারে! কয়েকটার ঠিকানা বাউন্ডারি লাইনের ধারে ফোটোগ্রাফারদের ঝাঁক, যাঁরা মোটামুটি তখন লেন্স ফেলে মাথা বাঁচাতে ব্যস্ত।

কিছুই না। মহেন্দ্র সিংহ ধোনি একটু হাত খুলেছেন!

Advertisement

একটা টিম কেমন, কোনও মেগা টুর্নামেন্টে নামার আগে ভেতরে ভেতরে কী চলছে বোঝার জন্য টিমের দশ জন প্লেয়ারকে দেখার প্রয়োজন সব সময় হয় না। একজনকে দেখলেই চলে। অধিনায়ক। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে দেখে বোঝা যেত তাঁর টিমের মাইন্ডসেট কী রকম দাঁড়াতে পারে। লোকে বুঝত, এরা সর্বকালের অন্যতম সেরা স্টিভ ওয়ের টিমকেও রেয়াত করবে না। ঠিক তেমনই অ্যাঞ্জেলো ম্যাথেউজকে দেখলেও টের পাওয়া যায়। না জেনেও ক্রিকেট-সাংবাদিক লিখে দিতে পারবে যে, বেটিং বাজারে টিম কোনও দরই পাবে না। এবং এই ধারণার বিচারে যদি প্রাক্-যুদ্ধ ভারতীয় শিবিরকে ধরতে হয়, যদি বুঝতে হয় এমএস ধোনিকে দিয়ে, ব্যাপারাটা এক লাইনে মিটিয়ে ফেলা যাবে।

বিপক্ষকুল, আগামী উনিশ দিন তোমাদের কপালে দুঃখ আছে!

আসলে গত এশিয়া কাপ থেকে যে ধোনির প্রত্যাবর্তন ঘটেছে, তিনি মধ্যে কোথাও যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন। ব্যাটে রান ছিল না। টিম হারছিল। অতীতের সেই শীতল হিংস্রতাও যেন ক্রমশ হারিয়ে যাচ্ছিল। সাংবাদিক সম্মেলন করতে বসে শুনতে হচ্ছিল, কবে যাচ্ছেন? ক্যাপ্টেন ‘কুল’ পরের পর মেজাজ হারাচ্ছিলেন। বেশি দূর পিছোতে হবে না। এশিয়া কাপে রওনা হওয়ার আগে কলকাতার প্রেস কনফারেন্স মনে করলেই চলবে। শুধু ধোনি কেন, টিমকেও তো কম কিছু শুনতে হয়নি। ধোনির ক্রিকেট-ক্ষুধা আর কতটা অবশিষ্ট, তা নিয়ে বরাবর ‘কমন’ একটা প্রশ্ন থাকত। কিন্তু মাত্র পনেরো দিনের একটা টুর্নামেন্ট যেন সব পাল্টে দিয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ফাইনালে ব্যাটিং অর্ডারে উপরে এসে ম্যাচ এক ওভার আগে শেষ করে দেওয়া, বিশ্বকাপের শেষ প্রস্তুতি ম্যাচে ধুঁয়াধার ব্যাটিংয়ের পর মিডিয়ার প্রশ্নের বিষয়ই এখন অন্য। বেশ কিছু দিন পর বোধহয় এ দিন জামথায় এমন একটা প্রাক্-ম্যাচ সাংবাদিক সম্মেলন করে গেলেন বিরাট কোহালি যেখানে টিম সম্পর্কে কোনও বেখাপ্পা প্রশ্ন তাঁকে শুনতে হল না। পুরোটাই প্রশংসা মেশানো প্রশ্নোত্তর পর্ব। আসলে অধিনায়ক-সহ টিমের খিদে তো আর প্রশ্ন করে কাউকে জানতে হচ্ছে না। চোখের সামনেই সবাই দেখতে পাচ্ছে।

শাস্ত্রীর ক্লাসে রোহিত। নাগপুরে সোমবার।

এক দিক থেকে দেখতে গেলে, ঠিকই আছে। মঙ্গলবার থেকে শুরু হতে চলা টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপই তো সম্ভবত দেশের হয়ে ক্রিকেটজীবনের শেষ মেগা টুর্নামেন্ট হতে চলেছে ভারত অধিনায়কের। নেটে দীর্ঘক্ষণ পড়ে থাকবেন, শেষ আগুন ছড়াবেন, নিজের ইচ্ছেকে টিমের অবেচতনে গুঁজে দেবেন এ সবই তো হওয়া উচিত। আর টিমও যে মঙ্গলবার নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে কাপ-যুদ্ধের প্রথম ধাপে নামার আগেই উদ্বোধনী ম্যাচ খেলতে নেমে পড়েছে, তা এ দিনের নেট সেশনই প্রত্যক্ষ প্রমাণ। উদাহরণ তুলে দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।

শিখর ধবন খেললেন গোটা তিরিশেক বল। বরাদ্দ সময়, আধ ঘণ্টা।

রোহিত শর্মা পঁচিশ থেকে তিরিশ বল ও আধঘণ্টা।

বিরাট কোহালি বলের সংখ্যা বেশি। গোটা ষাট-সত্তরের কাছাকাছি।

যুবরাজ সিংহ দশ থেকে পনেরো বল। নেমেই বড় হিটের প্রচেষ্টায়।

এম এস ধোনি বলের সংখ্যা ওই, এক-এক স্লটে দশ-বারো। আগ্রাসনের নমুনা আগেই লেখা হয়েছে।

মর্মার্থ, নিখাদ ম্যাচ সিচুয়েশন প্র্যাকটিস। ম্যাচে রোহিত-শিখর পাওয়ার প্লে-টা দেখে নেবেন। তিরিশ থেকে পঁয়ত্রিশ বল তাই একেবারে ঝালিয়ে নেওয়া হল। বিরাট ইদানিং শেষ পর্যন্ত থাকতে চাইছেন, তাই তাঁর বরাদ্দ সময় বেশি। ধোনি-যুবরাজের কাজ অন্য। বিপর্যয় না ঘটলে তাঁরা যখন নামবেন হাতে গোটা দশ-বারো বলই থাকবে। যা করার ওর মধ্যেই করতে হবে। অতএব, নেট সেশনকে গড়পড়তা নেট অ্যাক্টিভিটিজ না বানিয়ে ম্যাচটাই আগে খেলে নাও।

বিরাট কোহালিও যা বলে গেলেন তা প্রত্যেক ভারতবাসীকে উজ্জীবিত করে দেওয়ার মতো। বিশেষ করে বলার ভঙ্গিমা। কোহালি বললেন, “২০১১ বিশ্বকাপ জয়টা আমাদের নিশ্চয়ই সাহায্য করবে। দেশের মাটিতে এর চেয়ে বড় ফর্ম্যাটে বিশ্বকাপ জিতে থাকলে, বিশ্বাসটাই অন্য রকম হয়। তবে দেশের মাটিতে বিশ্বকাপ থাকলে প্রত্যাশার চাপটা অন্য রকম হয়।” একটু থেমে ফের বললেন, “আমি তখন জুনিয়র ছিলাম। দেখতাম সিনিয়রদের কত লোক এসে নানা রকম পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। দেশের মাটিতে খেলা হলে এক এক সময় মনে হয়, মাঠে থাকাই ভাল। ওখানেই চাপটা সবচেয়ে কম!” বলে হাসতে থাকলেন কোহালি। সঙ্গে বললেন যে, তাঁর উপর সেটা হলে অসুবিধে নেই। নিজেকে চ্যালেঞ্জ ফেললে তাঁর বেশ ভালই লাগে। চাপ থাকলে তাঁর পারফর্ম করার সুযোগটা বেড়ে যায়! আরও দু’টো জিনিস বলা হল। এক, টিম এখন শুধু চেষ্টা করছে নিজেদের শান্ত রাখতে। আবেগ আসবে, কিন্তু তাকে উপেক্ষা করতে। আর দুই, টুর্নামেন্টের ফেভারিট টিম ইন্ডিয়াকে বাছতে বললে উত্তরটা খুব সহজ টিম ইন্ডিয়া!

আগ্রাসন ও কর্পোরেট পেশাদারিত্ব থেকে খবরে এলে মোটামুটি তিনটে আছে। মহম্মদ শামির ফিটনেসে টিম খুশি কিন্তু আগামিকালই এশিয়া কাপ-জয়ী কম্বিনেশন ভেঙে তাঁর নামার সম্ভাবনা কম। রোহিত শর্মা নেটে একটু শরীর থেকে বাইরে-বাইরে খেলছিলেন। রবি শাস্ত্রী ডেকে নিজে শ্যাডো করে ব্যাপারটা দেখিয়ে দিলেন। আর হার্দিক পাণ্ড্যর পায়ে একটা স্ট্র্যাপ বাঁধা দেখা গেল।

যেগুলো একটাও খবর নয়।

আসল খবর তো শুধু ওই লোকটা। যে দৃশ্যত ছটফট করছে, হিংস্র আক্রমণ করছে নেহরা থেকে নেট বোলারকে। খবর তো ওই লোকটা যাঁকে সবাই ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ড্রেসিংরুমে ঢুকে যাওয়ার পরেও নেট থেকে ওঠানো যাচ্ছে না। খবর তো ওই লোকটা। কয়েক দিন আগেও কলকাতায় এক ঘনিষ্ঠকে যে বলে গিয়েছে, আর কিছু পাই না পাই, এই কাপটা আমার দেশের মাঠ থেকে চাই।

আজ রাত থেকে বিশ্বকাপ ক্রিকেট। আজ রাত থেকে দেশবাসীর ঘুম উড়ে যাওয়া। আজ রাত থেকে বিশ্বকাপের মতো মেগা টুর্নামেন্টে ‘ওয়ান লাস্ট আর্ট অব এমএস ধোনি’!

ছবি: উৎপল সরকার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন