এ ভাবেই সুযোগের পর সুযোগ নষ্ট করেছে এফসি গোয়া। ছবি: উত্পল সরকার
আটলেটিকো ০
এফসি গোয়া ০
আটলেটিকো দে কলকাতার নামটা মনে হয় পরিবর্তন করার সময় এসে গেল!
পনেরো ম্যাচের পর সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের টিমের নাম দেওয়া যেতেই পারে ‘আটলেটিকো ড্র কলকাতা’! আটটা ড্র! টুর্নামেন্টের আট টিমের কারও যে রেকর্ড নেই।
শেষ চারের প্রথম লড়াইও অমীমাংসিত থেকে গেল রবিবার!
আন্তোনিও হাবাসকে ম্যাচের পর দেখলাম একটা হাত মাথায়, আর একটা হাত কোমরে রেখে মাঠের ভিতর ঢুকে পড়েছেন। আর উল্টোদিকে জিকো মাঠে না ঢুকে মাথা নাড়তে নাড়তে ফিরে যাচ্ছেন ড্রেসিংরুমে। দেখে মনে হচ্ছিল দু’জনেই আরও নব্বই মিনিট রইল হাতে, এটা ভেবেই আশ্বস্ত হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। সাংবাদিক সম্মেলনে এসে সেটা উগরেও দিলেন—মনে যা-ই থাকুক মুখে আশ্বস্ত তো করতেই হবে।
সচিন তেন্ডুলকরের কেরল ইতিমধ্যেই প্রথম পর্বের তিন গোল এগিয়ে রয়েছে। বলা যায় সম্ভাব্য ফাইনালিস্ট। কিন্তু ফাইনালে সচিনের দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কে? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের কলকাতা না, গোয়া? সেটা তোলাই রইল মারগাও স্টেডিয়ামের ফিরতি ম্যাচের জন্য। উত্তেজক অবস্থায় সবারই অপেক্ষা বুধবার রাতের জন্য। মশালা টুর্নামেন্টের ভরপুর উত্তেজনা। খেলা যাই হোক আশা আশঙ্কার দোলচালে রেখে সমর্থকদের নেশা ধরিয়ে রাখা। টিভি টি আর পি চড়চড় করে বেড়ে যাবে এ বার।
দিল্লি ছিটকে যাওয়ার পর বিশ্বকাপজয়ী দেল পিয়েরো এখন টিভি ধারাভাষ্যকার। আইএসএলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডরও। সেই কাজে এ দিন তিনি হাজির ছিলেন স্টেডিয়ামে। ইতিহাস হয়ে থাকা অসাধারণ গোলের সামান্য নির্যাসও যদি দেল পিয়েরোর পা থেকে দেখা যায় এই আশায় মাস খানেক আগে কলকাতা-দিল্লি ম্যাচে যুবভারতীতে প্রায় আধ লাখ দর্শক এসেছিলেন। কলকাতাকে শেষ চারে দেখতে এ দিনও তিপ্পান্ন হাজারেরও বেশি দর্শক এসেছিলেন মাঠে। কলকাতা সত্যিই তা হলে ফুটবলকেও ভালবাসে। তারকাদের দেখতেই শুধু ভিড় করে না। কলকাতাকে জেতানোর জন্য সেই দর্শকরা মেক্সিকান ওয়েভ তুলছিলেন বারবার। সাদা-লাল ডোরাকাটা জার্সি পরে এসে গ্যালারি ভর্তি করে বসেছিলেন। মুখে রং, মাথায় এটিকে-র ফেট্টি— বিদেশের অনুকরণ করে এসেছিলেন অনেকেই। অদম্য সেই উত্সাহের ধাক্কায় মাঝেমধ্যে কেঁপে উঠছিল স্টেডিয়াম। কিন্তু কাজের কাজ গোলটাই যে হল না!
ড্র দেখে দেখে ক্লান্ত আটলেটিকো সমর্থকরা বাড়ি ফিরে যাচ্ছিলেন ম্যাচের পর। আসছে বছর আবার হবে, ভাবতে ভাবতে। কলকাতার মাঠে হাবাসের টিমের এটাই তো শেষ ম্যাচ হয়ে গেল। এরপর যা হবে সব গোয়া বা মুম্বইতে। দর্শকরা অনেকেই বাড়ি ফেরার আগে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে গ্যালারিতে বসে থাকা ফিকরু তেফেরার ছবি তুলে নিয়ে যাচ্ছিলেন। যা বেশ তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করছিলেন ইথিওপিয়ান স্ট্রাইকার। তিনি নেই, গোলও নেই,এটাই ভেবে হয়তো।
টিমের মধ্যে নিরন্তর ফিকরু বনাম স্প্যানিশ ফুটবলারদের লড়াই দেখে হাবাস বেছে নিয়েছিলেন গার্সিয়ার সতীর্থদেরই। কাঁটার চেয়ে স্বস্তি ভাল এই ফর্মুলার পর কলকাতার ফর্মেশন যা দাঁড়াল তাতে আঁতকে উঠতে হয়। ৪-২-৩-১। রফি শুধু স্ট্রাইকার। তা-ও ফিকরুর জায়গায়! ঘরের মাঠে আক্রমণাত্মক ভাবনা বাক্সবন্দি করে রেখে রক্ষণ জমাট করার স্ট্র্যাটেজি। পাল্টা আক্রমণের। গত মরসুমে চেলসি কোচ হোসে মোরিনহোর স্ট্র্যাটেজি তো ছিল এটাই। সিমিওনের ভক্ত হয়েও পরিস্থিতির চাপে পড়ে ‘দ্য স্পেশ্যাল ওয়ানে’-র সেই চালই হয়তো উদ্বুদ্ধ করেছিল কলকাতার হেড মাস্টারকে।
হাবাস আর একটা কাজ করেছিলেন। তা হল বিপক্ষের মাঝমাঠকে ধ্বংস করার ব্যবস্থা করেছিলেন রাকেশ মাসিদের দিয়ে। গোয়ার মাঝমাঠের সেরা অস্ত্র আন্দ্রে সান্তোসকে বোতলবন্দি করে দিয়েছিলেন তিনি। তেড়ে যাওয়া আর জোনাল মার্কিংয়ের ফর্মুলায়। ফলে হলটা কী, খেলাটা কখনও উঁচু মানের হল না। আটকে রইল মাঝমাঠে। পায়ের জঙ্গলে। তবে তার মধ্যেই বড় ক্ষতি হল গোয়ার। যুবভারতীর জঘন্য অ্যাস্ট্রোটার্ফে খেলার মাসুল দিতে হল ডিফেন্ডার নারায়ণ দাসকে। দলের অন্যতম সেরা ফুটবলারের এ ভাবে চোট পাওয়া দেখে জিকো বললেন, “এখানে অবসরপ্রাপ্ত ফুটবলারদের খেলা হতে পারে। আইএসএল নয়।”
হাবাসের তৈরি ‘লক গেট’ অথবা কৃত্রিম ঘাস-- গোয়াকে তাতেও আটকানো যাচ্ছিল না। কারণ জিকোর টিমের আক্রমণের বৈচিত্র্য। রোমিও আর মান্দারের উইং প্লে চোখ টানছিল বারবার। প্রচুর পাস খেলতে খেলতে মিডল থার্ড দিয়ে আক্রমণের ঝাপটায় কলকাতা পিছিয়ে যাচ্ছিল বারবার। স্টপ ওয়াচ বলছে পুরো ম্যাচে প্রায় ষাট মিনিট নিজেদের অর্ধে দশজন খেলেছে কলকাতা। তারই মধ্যে গোয়ার রোমিও আর স্লেপচিকা গোলের সহজ সুযোগ নষ্ট করলেন। স্লেপচিকা তো ওয়ান টু ওয়ান অবস্থায় তিন বার পেলেন কলকাতা কিপার বেটেকে। সফল হলেন না। তাঁর কোচ জিকো পেনাল্টি নষ্ট করে ব্রাজিলকে ছুটি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন ‘৮৬ বিশ্বকাপ থেকে। গোয়া যদি শেষপর্যন্ত টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে যায় তা হলে কিন্তু স্লেপচিকার দিকে আঙুল উঠবেই। কলকাতা যে সুযোগ পায়নি তা নয়। তবে মাত্র একটা— পদানি বলটা তুলে দিলেন গোয়া কিপারের হাতে। আর তাতেই হাবাস যে ভাবে মাথা চাপড়ালেন!
মজার ব্যাপার হল, যে টিমটা ড্রেসিংরুম রসায়নে দীর্ণ, যে টিমের ভারতীয় ফুটবলারদের বেশিরভাগই জঘন্য, যে টিমে পজিটিভ রাইট ব্যাক বা উইং নেই তারা এখনও ফাইনালে ওঠার দাবিদার হয়েই থাকল।
হাবাসের যা কপাল তাতে কলকাতা ফাইনালে যেতেই পারে। পরের ম্যাচে স্প্যানিশ কোচ পাবেন চোট সারিয়ে ফেরা ফিকরু-হোফ্রে-অর্ণবদের। সেই ভরসা থেকেই আপাতত গোয়ার দিকে তাঁকিয়ে থাকতে হবে আটলেটিকো প্রেমীদের। অপেক্ষা করতে হবে আরও তিন দিন, তিন রাত্রি। চাতক পাখির মতো।
আটলেটিকো: বেটে, কিংশুক, নাতো, হোসেমি, পদানি, সঞ্জু (রফিক), মাসি (লোবো), গার্সিয়া (আর্নাল), বোরহা, লেস্টার, রফি।