বাড়ির জানলা য়েন পাহাড়িয়া পথের ক্যানভাস।
উত্তরাখণ্ড, ভারতের উত্তর দিকে অবস্থিত এই ভূখণ্ডটি প্রাকৃতিক দৃশ্যের এক অভূতপূর্ব কোলাজ যার প্রতিটি শিরা-উপশিরায় বর্তমান অফুরন্ত মনোরম দৃশ্যপটের প্রাকৃতিক সম্ভার। আমাদের গন্তব্য কুমায়ুন হিমালয়ের নৈনিতাল থেকে আলমোড়া, কৌশানি, ও চৌকরি। তারপর হয়ে ফিরে আসা।
কলকাতা থেকে বিমানে চড়ে সন্ধে নাগাদ দিল্লি পৌঁছলাম। পুরনো দিল্লি স্টেশন থেকে রাত্রি ১০টা নাগাদ রানিখেত এক্সপ্রেসে চেপে কাঠগোদাম যখন পৌঁছলাম তখন সেখানে ভোর রাত্রি। আগে থেকে ঠিক করে রাখা গাড়িতে চেপে শুরু হল আমাদের সৌন্দর্যযাত্রা, গন্তব্য নৈনিতাল। ভোরের আলোয় অন্ধকার যত কাটতে লাগল তত স্পষ্ট হতে লাগল চোখের সামনের অপরূপ প্রাকৃতিক সম্ভার। দেখলাম আঁকাবাঁকা পাহাড়িয়া পথ বেয়ে গাড়ি এগিয়ে চলেছে আর দু’পাশের জানলাগুলো যেন কোনও ক্যানভাস। আর প্রকৃতি যেন সেই ক্যানভাসে আপন মনের খেয়ালে সৃষ্টি করে চলেছে একের পর এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্যপট। আর আমরা তখন শুধু মাত্র প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের ঘোরে বাঁধা পড়া মুগ্ধ দর্শক।
পাহাড়ের এক ঢাল থেকে দৃশ্যমান নৈনি লেক।
আরও পড়ুন: পায়ে পায়ে সান্দাকফু
নৈনিতাল
কাঠগোদাম থেকে গাড়িতে ঘণ্টাখানেকের মধ্যে পৌঁছনো যায় নৈনিতাল। লেক সংলগ্ন হোটেলের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে দু’-চোখ ভরে দেখলাম সামনের নৈনি লেককে। প্রথমে আমরা গিয়েছিলাম সেখানকার জুলজিক্যাল পার্কে। পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে রাস্তা করে তৈরি করা হয়েছে এই চিড়িয়াখানাটি। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী সম্বলিত এই চিড়িয়াখানাটি মন্দ নয়। পাহাড়ের বিভিন্ন ঢাল থেকে দৃশ্যমান নৈনি লেকের দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করার পর চড়াই-উতরাই ভেঙে চিড়িয়াখানা দেখার ক্লান্তি যেন সহজেই দূর হয়ে যায়। এরপর গেলাম লেক সংলগ্ন বাজার চত্বরে। নিজেদের জন্যই হোক বা কারও জন্য উপহারস্বরূপই হোক কেনাকাটার জন্য বাজারটি বেশ ভাল। বলা বাহুল্য, নৈনিতাল নানা রকমের মোমের পুতুলের জন্য প্রসিদ্ধ। সে দিন সন্ধ্যায় হঠাৎ শুরু হল তীব্র শিলাবৃষ্টি। হোটেলে ডিনার করতে করতে ব্যালকনি দিয়ে দেখতে পাওয়া এই অপূর্ব দৃশ্য অবশ্যই এই ভ্রমণ অভিজ্ঞতার উপরি পাওনা।
পরের দিন নয়নাদেবীর মন্দির এ পুজো দিয়ে লেকে বোটিং। নৈনি লেক যে কতটা বিপুলাকার তার একটা ধারণা তো আগে থেকে ছিলই। কিন্তু বোটে না উঠলে তার প্রকৃত বিপুলাকৃতির সম্বন্ধে সঠিক ধারণাটাই হত না। ভাবতে অবাক লাগে, দু’পাশে পাহাড়ের মাঝে বিশাল ভূখণ্ড জুড়ে শুধু সবুজাভ জল আর জল। কথিত আছে সতীর মৃত্যুতে ক্রোধে উন্মত্ত মহাদেব যখন ধ্বংসলীলায় উদ্যত, তখন ভগবান শ্রীবিষ্ণু তাঁর সুদর্শন চক্রে টুকরো টুকরো করে দেন সতীর দেহ আর দেবীর নয়ন জোড়া এসে পড়ে এই ভূখণ্ডে। এবং তার ফলেই সৃষ্টি হয় নয়নাকৃতি এই বিশাল তাল। তাই এই তালের নাম নৈনিতাল ও পাশের নয়নাদেবীর মন্দিরও সেই সূত্রে গড়া। লেক সংলগ্ন রোপওয়ে স্টেশন থেকে রোপওয়েতে চড়ে পাহাড়ের ও নীচের লেকের দৃশ্য উপভোগ করা এখানকার আরও একটি আকর্ষণ। রোপওয়েতে চড়ে এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ে পৌঁছে সেখান থেকে দেখা যায় সুবিশাল হিমালয় পর্বতমালা। হাতে কিছুটা সময় থাকলে লেক সংলগ্ন ম্যাল রোড থেকে গাড়ি বুক করে ঘুরে আসতে পারেন নয়না পিক, টিফিন টপ, স্নো ভিউ পিক, ল্যান্ডস এন্ড, সাত তাল, অ্যানিম্যাল, পাখিরালয় প্রভৃতি।
কোথায় থাকবেন?
নৈনিতালে ম্যাল রোড সংলগ্ন অনেক হোটেল আছে। যেমন, দ্য নৈনি রিট্রিট, হোটেল কৃষ্ণ ইত্যাদি। এ ছাড়া কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের (কেএমভিএন) ওয়েবসাইট থেকেও ঘর বুক করতে পারেন। মরসুমে ঘরভাড়া প্রায় ২৬০০ থেকে শুরু। আর অফ সিজনে ১৫০০ থেকে শুরু। আগে থেকে প্ল্যান করে বিভিন্ন অনলাইন বুকিং ওয়েবসাইটগুলিতে খেয়াল রাখলে, পেতে পারেন ভাল ডিল।
দ্য নৈনি রিট্রিট: bookings@leisurehotels.in
যোগাযোগ: +৯১৯৫৫৫০৮৮০০০/+৯১১১৪৬৫২০০০০
হোটেল কৃষ্ণ: info@hotelkrishna.com,
যোগাযোগ: +৯১-৫৯৪২-২৩৭৫৫০/+৯১-৯৯২৭৯৪৪৪৭৩
কেএমভিএন: www.kmvn.gov.in: crckmvn@gmail.com, +৯১৭০৫৫৭১৫২৫১/+৯১৫৯৪২২৩১৪৬৩/+৯১৫৯৪২২৩৬৯৩৬/+৯১৫৯৪২২৩৫৬৫৬
সর্পিলাকার পথের কৌশানি যেন হিমালয়ের রানি।
আরও পড়ুন: মোহময়ী অযোধ্যার হাতছানি
কৌশানি
এ বার গন্তব্য কৌশানি। নৈনিতাল থেকে একই গাড়িতে চেপে সর্পিলাকার পাহাড়িয়া পথ দিয়ে পাইন গাছের সবুজ জঙ্গলের বুক চিরে আমাদের গাড়ি এগিয়ে চলল কৌশানির উদ্দেশে। কৌশানিতে যে হোটেলটি বুক করা হয়েছিল সেটির বিশেষত্ব হল তার ঘরের দেওয়ালপ্রমাণ জানলা দিয়ে দেখা যাওয়া হিমালয়ের শৃঙ্গ। কিন্তু তা কোন সময় ধরা দেবে তা নির্ভর করে আবহাওয়ার উপর। সাধারণত এক পশলা বৃষ্টির পর এই তুষারশৃঙ্গ দেখার সম্ভাবনা সব থেকে বেশি। তাই যখন হোটেলে গিয়ে জানতে পারলাম যে সদ্য বৃষ্টিপাত হয়েছে, আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে ছুটলাম ঘরের দিকে। জানলার পর্দা সরাতেই চাক্ষুষ করলাম চিরতুষারাবৃত হিমালয়ের গগনচুম্বী শৃঙ্গ। খাওয়াদাওয়া সেরে গেলাম কৌশানির অন্যতম আকর্ষণ গাঁধীজির আশ্রমে। দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহের দিক থেকেও এটি গুরুত্বপূর্ণ। আশ্রমের পিছনে পাহাড়ের ধারে, গাছের ছায়ায়, বেড়ায় ঘেরা অঞ্চলটিতে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ হয়ে অনুভব করতে লাগলাম এখানকার অনাবিল সৌন্দর্যকে। হয়তো ঠিক এমন ভাবেই মুগ্ধ হয়ে গাঁধীজি কৌশানিকে আখ্যা দিয়েছিলেন ‘দ্য সুইজারল্যান্ড অব ইন্ডিয়া’। এখানে শুধু পাহাড়ের গায়ে ধাপে ধাপে সাজানো পাইন গাছের আড়ালে বা ব্যালকনি থেকে পাহাড়চূড়া দেখেই বেশ কয়েক দিন কেটে যায়। এখানকার রুদ্রনাথ গুহা ও ঝরনা এবং অবশ্যই কৌশানি শাল ফ্যাক্টরি পর্যটকদের অবশ্য গন্তব্য।
ঘন জঙ্গলে মোড়া বিনসর।
বিনসর
পরের দিন কৌশানি থেকে প্রায় ৭০ কিমি দূরে অবস্থিত বিনসরের ঘন জঙ্গলের উদ্দেশে রওনা হলাম। গাড়িতে কৌশানি থেকে বিনসর পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। কিছু দূর গাড়ি যাওয়ার পর বাকিটা পায়ে হেঁটে পাহাড়ে উঠতে হয়। আর সেই চলার মাঝেই অহরহ বিভিন্ন জন্তু-জানোয়ারের ডাক কানে আসতে থাকে। ভাগ্যে থাকলে দিনের আলোতে দেখা মিলতে পারে হরিণ বা অন্য কোনও প্রাণীর। বিনসরের এই গা ছমছমে পরিবেশে কেএমভিএন-এর রিসর্টে রাতে থাকারও ব্যবস্থা আছে। আমাদের ড্রাইভার বললেন যে সন্ধের পর এখানে না কি বিদ্যুৎ থাকে না। তাই অনেকেই জঙ্গলের অনুভূতি পেতে এখানে অন্তত একটি রাত কাটিয়ে থাকেন। দিনের আলো থাকতে থাকতেই কৌশানিতে হোটেলে ফিরে এলাম।
কোথায় থাকবেন?
কেএমভিএন টুরিস্ট রেস্ট হাউজ, বাগেশ্বর ৮৬৫০০০২৫৪৫, ৮৬৫০০০২৫৩৭ (বিনসর) www.kmvn.gov.in, যোগাযোগ: crckmvn@gmail.com কৌশানিতে দ্বিশয্যা প্রতি দিন: ১৭০০ টাকা থেকে শুরু। বিনসরে দ্বিশয্যা ঘর প্রতি রাত্রি ৬৪০০ থেকে শুরু।
হোটেল সাগর: Sumanhotels.com, ৯৯৯৭২৫৫৯৩৩, ৯৮৭৩৬৩৫৩৭০, স্ট্যান্ডার্ড রুম এর ভাড়া ৯০০ টাকা থেকে শুরু। আরও বিশদ বিবরণের জন্য দেখুন www.kausanihotel.com/tariff-packages.html
আরও পড়ুন: ঈশ্বরের আপন দেশে
চৌকরি
কৌশানিতে দু’রাত কাটিয়ে এ বার গন্তব্য চৌকরি। গাড়িতে কৌশানি থেকে আলমোড়া হয়ে চৌকরি পৌঁছতে সময় লাগে প্রায় চার ঘণ্টা। পথে যাওয়ার সময় দু’চোখ ভরে উপভোগ করলাম আলমোড়ার অপরূপ সৌন্দর্য। যাওয়ার পথে গোলু চেতনা, বৈজনাথ, বাগেশ্বর, সোমেশ্বরের মতো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য মন্দির পড়ে। অনেকে মনের ইচ্ছে জানিয়ে তা পূর্ণ হওয়ার আশায় একটি ঘণ্টা বেঁধে দেয় এই গোলু চেতনা দেবীর মন্দিরে আর তাই মন্দির চত্বরে প্রবেশ করলে চোখে পড়ে চারিদিকে ঘিরে থাকা বিভিন্ন আকারের ঘণ্টা। চৌকরিতে পৌঁছনোর পরেও সারা রাত ধরে হল তুমুল বৃষ্টি।
এখানে মেঘ গাভীর মতো চড়ে।
পরের দিন বেশ ভোরে বেরিয়ে পড়লাম আরও ভাল করে হিমালয়ের চূড়া দেখার অদম্য ইচ্ছে নিয়ে। আসলে তত দিনে প্রকৃতির উজাড় করা সম্ভার যতটা সম্ভব চেটেপুটে উপভোগ করেছি দু’চোখ ভরে আর তার সঙ্গে লোভটাও আরও বেড়েছে, আর তাই কিছুতেই মন যেন তুষ্ট হতে চাইছিল না। তাই হোটেল থেকে বেরিয়ে হেঁটে সামনের পাহাড়ের মাথায় পৌঁছে গেলাম। প্রত্যেকটা পদে পদে প্রকৃতি যেন তার রূপলাবণ্য সাজিয়ে বসে আছে। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে দু’চোখ ভরে দেখলাম ওই দূরে রাশি রাশি গিরিশৃঙ্গ মাথায় বরফের সাদা মুকুট পরে রাজার আসনে অধিষ্ঠিত। নীচের বাড়িগুলো অনেকটা ছোট ছোট দেশলাইয়ের বাক্সের মতো দেখতে লাগছে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ওই যে দূরে দেখা যাচ্ছে আমাদের রিসর্ট। দেখতে দেখতে মনে হল প্রকৃতি তার সমস্ত রহস্যময়তা ও সৃষ্টি উজাড় করে দিয়েছে আমাদের। আর আমরা তাকেই ধ্বংস করে চলেছি।
চৌকরি হল মেঘের দেশ। পরের দিন সকালে হোটেল থেকে বেরনোর সময় হঠাৎ চারিদিক মেঘাচ্ছন্ন হয়ে গেল আর শুরু হল অঝোরে বৃষ্টি। বৃষ্টি থামার পর যা দৃশ্য দেখলাম তার জন্য চৌকরি আমার মনের চিলেকোঠায় সব সময় আলাদা জায়গা করে নেবে। দেখলাম চারিদিকে আবছা অন্ধকার, আকাশে কুণ্ডলীকৃত কালো মেঘ আর ওই দূরে গিরিশৃঙ্গ। শ্বেতশুভ্র সাদা চূড়াগুলি থেকে সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়ে উজ্জ্বল হয়ে ফুটে উঠেছে, যেন মনে হচ্ছে প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে কোনও এক অন্ধকার ঘরে আলো জ্বালিয়ে উজ্জ্বল করে রেখেছে তার অভূতপূর্ব এই সৃষ্টি দিয়ে। চৌকরিতে হিমালয়ের এই নয়নভোলানো সৌন্দর্য মনের মধ্যে নিয়ে এ বার ফেরার পালা! সেই আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা, পাইনের জঙ্গলের ভিতর দিয়ে গাড়ি এগিয়ে চলল সমতলের দিকে।
নয়নভোলানো সৌন্দর্য ঘেরা চৌকরি।
কোথায় থাকবেন?
কেএমভিএন টুরিস্ট রেস্ট হাউজ, পিথোরাগড় +৯১৮৬৫০০০২৫৪২, দ্বিশয্যা ঘর দৈনিক ১৪৫০ টাকা । www.kmvn.gov.in, crckmvn@gmail.com
ওজস্বী রিসর্ট, www.ojaswiresort.com, stay.ojaswi@gmail.com ojaswi.resort@gmail.com, ৯৬৩৯১২১৪২০, ডিলাক্স রুম দৌনিক ২৭০০ টাকা ও অতিরিক্ত কর। আরও বিশদ বিবরণের জন্য দেখুন www.ojaswiresort.com/chaukori/tariff/tariff.html
কী ভাবে যাবেন?
কলকাতা থেকে ট্রেন বা বিমানে দিল্লি। দিল্লি থেকে ট্রেন, বিমান অথবা সড়কপথে পৌঁছতে পারেন নৈনিতাল। পুরনো ও নতুন দিল্লি স্টেশন থেকে কাঠগোদাম পর্যন্ত ট্রেন আছে। দিল্লি থেকে সড়কপথে নৈনিতাল পৌঁছতে প্রায় ৬ ঘণ্টা লাগে। নৈনিতালের কাছাকাছি বিমানবন্দর পান্থগড়। কাঠগোদাম থেকে গাড়ি নিয়ে পুরোটা ঘোরা ভাল। গাড়ির জন্য যোগাযোগ করতে পারেন: সঞ্জয় থাপার ৮৪৭৬০৮৬৪০৩।
মনে রাখবেন, গাড়ি ও হোটেল বুকিংয়ের সময় সাম্প্রতিকতম দর জেনে নেবেন। মরসুম ভেদে এই দর ওঠানামা করে।
ছবি: লেখক।