Advertisement
E-Paper

ঈশ্বরের আপন দেশে

পশ্চিমঘাট পর্বতমালার এ শৈল শহরে জলপ্রপাত, নদী, ঝরণা— সবই রয়েছে। স্নিগ্ধ ঠান্ডায় ঘুরে আসতে পারেন কেরলের শৈল শহর মুন্নারে। লিখছেন আর্যভট্ট খান কেরল ভ্রমণের সূচিতে যখন মুন্নারে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম তখন কয়েক জন বন্ধু বলেছিল, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চা বাগান তো উত্তরবঙ্গেই দেখা যায়।

শেষ আপডেট: ২১ জানুয়ারি ২০১৮ ০২:৪১
পেরিয়ার লেক।

পেরিয়ার লেক।

কোথাও সবুজের রং গাঢ়। কোথাও বা হালকা। কোথাও আবার সবুজের মধ্যে মিশে রয়েছে ধূসরতা। এই দিগন্ত বিস্তৃত সবুজকে ছুঁয়ে রয়েছে পেঁজা তুলোর মতো মেঘ।

কেরল ভ্রমণের সূচিতে যখন মুন্নারে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছিলাম তখন কয়েক জন বন্ধু বলেছিল, পাহাড়ের ঢাল বেয়ে চা বাগান তো উত্তরবঙ্গেই দেখা যায়। এ জন্য ২০০০ কিলোমিটার পথ উজিয়ে মুন্নারে যাওয়ার দরকার কী? বড়দিনের ছুটিতে হালকা শীত মাখানো বিকেলে যখন মুন্নারে পৌঁছলাম তখন মনে হয়েছিল ভাগ্যিস বন্ধুদের কথা শুনে মুন্নার যাওয়ার পরিকল্পনা বাতিল করিনি। এখানে এসে বুঝলাম কেরলের পশ্চিমঘাট পর্বতমালার ৫২০০ ফুট উচ্চতায় মুন্নারে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে শুধু চা বাগানই নয় এখানে জলপ্রপাত থেকে শুরু করে নদী, নদী বাঁধ,
ঝরণা, আয়ুর্বেদিক বাগান, টি-মিউজিয়াম, ফুলের বাগান ব্লুজোম পার্ক— সবই রয়েছে। সব মিলিয়ে শৈল শহর মুন্নার যেন সবার থেকে আলাদা। মুন্নারে সব থেকে ভাল দিক হল এটি শৈল শহর হলেও অসহনীয় ঠান্ডা পড়ে না। ডিসেম্বর, জানুয়ারিতেও মুন্নারের ঠান্ডায় স্নিগ্ধতার ছোঁয়া লেগে থাকে।

তবে কেরল সফর শুরু মুন্নার নয়, কোচি থেকে শুরু করাই ভাল। কোচি শহরে আরব সাগরের তীরে ফোর্ট কোচি, ডাচ প্যালেস, ইহুদিদের সিনাগগ, চাইনিস ফিসিং নেট ও অবশ্যই ফ্লোকলোর মিউজিয়াম দেখুন। ফোর্ড কোচিতে দেখুন ভাস্কো দাগামার সমাধিস্থল। পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো দাগামার স্মৃতিবিজরিত এই ঐতিহাসিক সমুদ্র শহরে রয়েছে ব্যাক ওয়াটারে নৌকা নিয়ে ঘোরার সুযোগ। যাঁরা ঐতিহাসিক শহর দেখতে ভালবাসেন তাঁরা কোচিতে দু’রাত থেকে যান। না হলে এক রাত থেকেই পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লে সারা দিনে কোচি শহর ঘুরে নেওয়া যায়।

কোচি থেকে দুপুরে বেরিয়ে মুন্নার আসার পথে দেখে নিতে হবে ভারালা জলপ্রপাত। পথেই পড়ে এই জলপ্রপাত। ওখান থেকে একটু এগিয়ে কোনও এক আয়ুর্বেদিক বাগানে ঢুকে পড়ুন টিকিট কেটে। নানারকম আয়ুর্বেদিক গাছের সন্ধান দেবে গাইড। সন্ধ্যা সন্ধ্যা মুন্নারে পৌঁছে হোটেলে চেক ইন করে বেরিয়ে পড়ুন এই অসম্ভব সুন্দর শৈল শহরের রাতের সৌন্দর্য উপভোগ করতে।

পরের দিন সকাল সকাল উঠে ঘুরতে বেরিয়ে না পড়লে সারা দিনে কিন্তু মুন্নারের সবকিছু ঘুরে দেখা সম্ভব নয়। ফলে হোটেলে ব্রেকফাস্ট করে আটটা থেকে সাড়ে আটটার মধ্যে বেরিয়ে পড়াই ভাল। আমাদের গাড়ির চালক ডেভিডই ছিল আমাদের ট্যুর গাইড। ডেভিড বলেন, ‘‘মুন্নার এত সুন্দর যে সারাদিন টইটই করে ঘুরলেও ক্লান্ত হবেন না। প্রকৃতির এই রুপ রসে ডুব দিয়ে বরং আরও চাঙ্গা হয়ে যাবেন।’’

চা-বাগানে ঢাকা মুন্নারের পাহাড়।

ডেভিড যে কিছু ভুল বলেননি তা সারাদিন ঘুরেই বোঝা গেল। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে চা বাগানের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রাণভরে ছবি তোলার পরে আপনি সোজা চলে যান মাতুপট্টি লেক ও ড্যামে। পাহাড়ের কোল ঘেঁষে মাতুপট্টি লেকের অন্য প্রান্তে মেঘের খেলা দেখুন প্রাণভরে। সেখান থেকে সোজা চলে যান ইকো পয়েন্টে। ইকো পয়েন্টের লেকের ধারে দাঁড়িয়ে আপনি চিৎকার করে যাকে ডাকবেন কাছের পাহাড় তা প্রতিধ্বনি করে ফিরিয়ে দেবে। ইকো পয়েন্টের ধারে আছে প্রচুর গিফট শপ। এখান থেকে আত্মীয় পরিজনদের উপহারের দেওয়ার জন্য কেরলের মশলা থেকে শুরু করে নানা ধরনের জিনিস কিনে নিতে পারেন। দরদাম করে কিনতে পারলে কম দামেই পাবেন।

মুন্নারের রাস্তায় বিভিন্ন বাঁকে রয়েছে নানা রকমের চমক। এ রকমই এক চমকের নাম ব্লুজম পার্ক। এই পার্কের ভেতর ঢুকে ফুলের গাছ ও অর্কিডের সম্ভার দেখে মনে হবে এমন কোনও রং নেই যার দেখা ব্লুজম পার্কে মেলে না। মুন্নারে এলে টি-মিউজিয়াম দেখতে ভুলবেন না যেন।

মুন্নার গেলেন আর অফ রুট জিপ সাফারি করবেন না তা হয় নাকি? অফ রুট মানে জঙ্গলের মধ্যে ভাঙাচোড়া রাস্তা যে রাস্তা দিয়ে শুধু জিপই যেতে পারে সেই রাস্তা ধরে আপনি চলে যাবেন নির্জন এক জলপ্রপাতের কাছে। চলে যাবেন এক ঝুলন্ত সেতুর সামনে। শাহরুখ খান অভিনীত বিখ্যাত ছবি ‘চেন্নাই এক্সপ্রেসের’ একটি শ্যুটিং স্পটেও নিয়ে যায় জিপ সাফারি। জিপে করেই পৌঁছে যান পাহাড়ের উপরে ভিউ পয়েন্টে। যে ভিউ পয়েন্ট থেকে আপনি মুন্নারের অনেকটা দেখতে পাবেন। বিকেলে গেলে এখান থেকেই সূর্যাস্ত দেখা যায়। দেখা যায় কী ভাবে চা বাগানের মধ্যে মেঘ ভেসে যাচ্ছে। মুন্নারের ভেতর এক অচেনা মুন্নার দেখতে গেলে জিপ সাফারি করতেই হবে। তিন ঘণ্টার অফ রুট জিপ সাফারিতে একটা জিপের ভাড়া আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা।

কুয়াশা ঘিরেছে মুন্নারে। নিজস্ব চিত্র

সাধারণত বেড়াতে গিয়ে সন্ধ্যাবেলা হোটেলে চলে বিশ্রাম নেওয়াই দস্তুর। কিন্তু মুন্নারের সন্ধ্যাও আপনাকে ব্যস্ত রাখবে। সন্ধ্যায় দেখে আসুন কথাকলি শো ও মার্শাল আর্ট শো। মাথাপিছু ২০০ টাকার বিনিময়ে এক একটি শো দেখা যায়। এই মার্শাল আর্টের স্থানীয় ভাষায় নাম কলারিপাট্টু। স্থানীয় বাসিন্দাদের দাবি, মার্শাল আর্টের জন্মস্থল এই কেরলেই। পরের দিন সকাল সকাল প্রাতরাশ খেয়ে বেরিয়ে পড়ুন থেক্কাডির উদ্দেশ্যে। তিন ঘণ্টার পাহাড়ি পথ যেন পিকচার পোস্টকার্ড। প্রকৃতির শোভা দেখতে দেখতে কখন যে থেক্কাডি পৌঁছে যাবেন তা খেয়ালই থাকবে না। তবে থেক্কাডি শহরে ঢোকার ঠিক আগে চলে আসুন তামিলনাড়ু ভিউ পয়েন্ট দেখতে। তামিলনাড়ু ঘেষা থেক্কাডি শহরের একটি পাহাড় থেকে তামিলনাড়ুর একটি বিস্তৃত অঞ্চল দেখতে পাওয়া যায়। টিকিট কেটে জিপে করে নিয়ে যাওয়া হয় সেই ভিউ পয়েন্টে। মাথা পিছু পাঁচশো টাকার টিকিটে শুধু জিপ সাফারি করে তামিলনাড়ু ভিউ পয়েন্টই নয়, চড়তে পারবেন হাতির পিঠেও। হাতির পিঠে মিনিট কুড়ি সাফারি সঙ্গে হাতির সঙ্গে যত ইচ্ছা ছবি তোলার সুযোগও পাবেন।

এ দিন দুপুর দুপুর থেক্কাডি পৌঁছে গেলে চলে যান পেরিয়ার লেকে। পেরিয়ারে টাইগার রিজার্ভ ফরেস্ট ঘোরা যাবে লঞ্চে চেপে। দেড় থেকে দু’ঘণ্টার এই লঞ্চ সফরে যদি বন্যপ্রাণীর সন্ধান নাও মেলে তবু লেকের সৌন্দর্য দেখে মন ভরে যাবে। আর হঠাৎ করে জঙ্গল ফুঁড়ে যদি হাতি বেরিয়ে আসে আর হাতিকে লেকের জল খেতে দেখা যায় তা হলে তো সেটা আপনার উপরি পাওনা হয়ে গেল। তবে থেক্কাডি পৌঁছাতে যদি বিকেল হয়ে যায় তা হলে সে দিন না গিয়ে পরের দিন সকালে উঠে চলে যান পেরিয়ার লেকে লঞ্চ সফরে। সন্ধ্যায় ঘুরে কিনে নিন প্রিয়জনদের জন্য নানা উপহার। কেরালার শাড়ি থেকে শুরু করে কাঠের ছোটো ছোটো অভিনব উপহার সামগ্রী দরদাম করে কিনতে হবে। এখানেও রয়েছে কথাকলি ও মার্শাল আর্ট শো। তবে এই দুই শো যদি আপনি মুন্নারে দেখে ফেলেন তাহলে থেক্কাডিতে আর দেখার দরকার নেই।

থেক্কাডিতে অনেকে এক রাত থাকেন অনেকে আবার দু’রাতও থাকেন। যে ক’দিনই থাকুন না কেন থেক্কাডি ছাড়ুন সকাল সকাল। বেরিয়ে পড়ুন ১৪০ কিলোমিটার দূরে আলেপ্পির উদ্দেশে।

Kerala Munnar Periyar Tourist Spot Holiday Destination পশ্চিমঘাট পর্বতমালা পেরিয়ার লেক
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy