hampi

হাম্পির বুক জুড়ে অমলিন ইতিহাস

তুঙ্গভদ্রার তীরে গড়ে ওঠা ঐতিহাসিক হাম্পি মোহময়ী। এ শহরের আনাচকানাচে জড়িয়ে নানা বংশের রাজত্বগাথা, পৌরাণিক কাহিনি।

Advertisement

পার্থসারথি গোস্বামী

শেষ আপডেট: ১১ অক্টোবর ২০১৯ ১৪:৪৯
Share:

বিশালকায়: হাম্পির বিরূপাক্ষ মন্দির

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম রবিবার। দুপুরে হঠাৎই ভাইয়ের ফোন। বলল ই-মেল খুলে দেখতে। দেখি, হাম্পি যাওয়ার এয়ারটিকিট পাঠিয়েছে ভাই। মঙ্গলবারের টিকিট। হাতে মাত্র একটা দিন। তাড়াহুড়ো করে ব্যাগ গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে দমদম এয়ারপোর্ট থেকে হায়দরাবাদ, সেখান থেকে জিন্দাল বিদ্যানগর এয়ারপোর্ট। বিমানবন্দরের বাইরে দেখি, ভাই অপেক্ষা করছে। ঠিক হল, সে দিনটা বিশ্রাম নিয়ে পরদিনই বেরিয়ে
পড়া হবে।

Advertisement

পরদিন সকালে প্রস্তুত হওয়ার আগেই দেখি, গাইড হাজির। সকাল সাতটায় যাত্রা শুরু করলাম। শুনলাম, তোরঙ্গল্লু থেকে হাম্পির দূরত্ব ৩২ কিলোমিটার। তুঙ্গভদ্রা নদীর তীরে সঙ্গমপুত্র হরিহর ও বুক্কা ১৩৩৬ সালে গুরু বিদ্যারায়নের নির্দেশে বিজয়নগর সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। পিতার নামানুসারে রাজবংশের নাম হয় সঙ্গম রাজবংশ। হরিহর ছিলেন এই সাম্রাজ্যের প্রথম শাসক। বিজয়নগর সাম্রাজ্যে ১৩৩৬-১৬৭২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত শাসনকালে ‘সঙ্গম’, ‘সালুভ’, ‘তুলুভ’ ও ‘আরবিভু’ নামে চারটি রাজবংশ রাজত্ব করে। বিজয়নগর সাম্রাজ্য ছিল সেই সময়ের দক্ষিণ ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী হিন্দুরাজ্য। শিল্প, সংস্কৃতি, শিক্ষায় ইতিহাসের পাতায় এক দৃষ্টান্ত স্থাপন করে বিজয়নগর সাম্রাজ্য। রাজারা হিন্দুধর্মাবলম্বী হওয়ার কারণে সেই সময়ে সমগ্র বিজয়নগর সাম্রাজ্য জুড়ে গড়ে ওঠে প্রচুর মন্দির। ইতিহাসবিদদের মতে, বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রাজা ছিলেন কৃষ্ণদেব রায়। তাঁর রাজত্বকালে গুণমানের দিক দিয়ে স্থাপত্যশিল্প এক অনন্য নজির সৃষ্টি করে। হাম্পি ছিল বিজয়নগরের রাজধানী। পরবর্তী কালে বাহমনি রাজ্যের সুলতান দীর্ঘদিন ধরে বিজয়নগরকে লুট করে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। হাম্পি জুড়ে ছড়িয়ে আছে তৎকালীন স্থাপত্যের সব ধ্বংসাবশেষ। জনশ্রুতি, হিন্দু পুরাণ মতে সতী দেহত্যাগের পরে পুনর্বার জন্ম নেন ব্রহ্মাকন্যা পম্পা নামে। পম্পা কঠোর তপস্যায় শিবকে পুনরায় পান পতিরূপে। বিবাহস্থানের নাম হয় পম্পাক্ষেত্র। সংস্কৃত শব্দ পম্পা কন্নড়ে হাম্পে থেকে হাম্পিতে পরিবর্তিত হয়েছে। ১৯৮৬ সালে ইউনেসকো ওয়র্ল্ড হেরিটেজ সাইট বলে স্বীকৃতি দেয় হাম্পিকে।

ঐতিহাসিক: লোটাস মহল

Advertisement

প্রথমে আমাদের গন্তব্য ছিল হাম্পির প্রাচীন স্থাপত্য নিদর্শন বিরূপাক্ষ মন্দিরে। কেউ কেউ আবার একে পম্পাপতির মন্দিরও বলেন। মন্দিরের কারুকাজ দেখে সত্যিই জুড়িয়ে গেল চোখ। প্রবেশপথে চোখধাঁধানো দু’টি গোপুরম অর্থাৎ প্রবেশতোরণ ও দু’টি বিশালাকার প্রাঙ্গণ। মন্দিরের মূল গর্ভগৃহে রয়েছে পাথরের তৈরি বিশাল শিবলিঙ্গ। এ ছাড়াও মন্দিরের ভিতরে রয়েছে পম্পাদেবী, ভুবনেশ্বরী, পাতালেশ্বর, সূর্যনারায়ণ প্রভৃতি আরও মন্দির। পাশ দিয়েই বয়ে গিয়েছে তুঙ্গভদ্রা নদী। মনোরম পরিবেশে সেই অবাক করা প্রাচীন ভাস্কর্যের নিদর্শন দেখতে দেখতে কেটে গেল বেশ কিছুটা সময়। বিরূপাক্ষ মন্দির থেকে বেরিয়ে রওনা দিলাম বিজয়ভিত্তল মন্দিরের উদ্দেশে। পথের মাঝে গাড়ি পার্ক করে ব্যাটারিচালিত গাড়িতে চেপে পৌঁছলাম বিজয়ভিত্তল মন্দিরের মূল গোপুরমের সামনে। কোনও রকম মর্টার ব্যবহার না করে পাথরের উপরে পাথর চাপিয়ে তৈরি করা প্রতিটি শিল্পকর্ম দেখে শুধুই অবাক হওয়ার পালা। মন্দির চত্বরে প্রবেশ করার পরে দেখলাম, মন্দির প্রাঙ্গণে রয়েছে গ্রানাইট পাথরের তৈরি একটি সুবিশাল রথ। তার গায়ে গায়ে সূক্ষ্ম কারুকার্য। যেটি মুদ্রণ করা ভারত সরকারের নতুন ৫০ টাকার নোটে। রয়েছে মিউজ়িক টেম্পল। একক পাথরের তৈরি বিশালাকার ১৬টি স্তম্ভ ধরে আছে মন্দিরের ছাদ। কান পেতে আঘাত করলেই শোনা যায় সরগমের সপ্তসুর। মন্দির চত্বরের কিছুটা পূর্ব দিকে রয়েছে কিং ব্যালান্স। যেখানে নাকি রাজারা নিজের সমান ওজনের সোনাদানা মণি-মুক্তো ওজন করে দান করতেন ব্রাহ্মণ ও গরিবদের মধ্যে। দেখা যায় রামায়ণ বর্ণিত হনুমানের জন্মস্থান অঞ্জনী পর্বতও। ফেরার রাস্তায় সারি সারি প্রস্তর নির্মিত পশরা ও রানিদের স্নান করার জন্য বিরাট স্নানাগার। দুপুর পেরিয়ে বিকেল হয়ে এল। এক এক করে দেখতে থাকলাম হাতিশালা, নৃসিংহ মূর্তি, লোটাস মহল, কমলাপুরা মিউজ়িয়াম...

ঘুরে দেখলাম হাম্পি গ্রামও। সূর্য তখন ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। গোটা একটা দিন কী ভাবে কেটে গেল, বুঝতেই পারলাম না। মন না চাইলেও এ বার ফেরার পালা। ইতিহাসের পদচিহ্ন দর্শন করে বুঝলাম হাম্পির আনাচকানাচে ছড়িয়ে থাকা এই সব মন্দির, প্রাসাদ, বিলাসভবন, পশরা দেখে পুরো হাম্পির স্বাদ গ্রহণ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। তবুও মনের মাঝে যেটুকু স্মৃতি সঞ্চয় করলাম, তা অমলিন থাকবে আজীবন।

রুট ম্যাপ

হায়দরাবাদ বা বেঙ্গালুরু থেকে জিন্দাল বিদ্যানগর এয়ারপোর্টে নেমে তোরঙ্গল্লু। সেখান থেকে হাম্পি ৩২ কিলোমিটার। ট্রেনে গেলে নামতে হবে হোসপেট। সেখান থেকে ১৩ কিলোমিটার হাম্পি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন