মেদিনীপুরের হাতে কালীঘাটের পটভাগ্য

এ পট মেদিনীপুরের পটুয়ারা আগে আঁকতেন না! কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার প্রায় ৮০ বছর পরে মেদিনীপুরের পটুয়াদের হাত ধরে লুপ্তপ্রায় সেই পটই ফিরে পেয়েছে নতুন আঙ্গিক। সাবেক কালীঘাটের পটচিত্রের অনুকরণে ফুটে ওঠে নানা ছবি— ‘মোহন্ত-এলোকেশী’, ‘বেড়াল তপস্বী’, ‘বাবু-বিবি’ কিংবা ‘বীণাবাদিনী’। এ ছবি আঁকছেন কারা? পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার পটুয়ারা। লিখছেন বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য শুধুমাত্র আনন্দবাজার ওয়েবসাইটের জন্য

Advertisement

বিভূতিসুন্দর ভট্টাচার্য

শেষ আপডেট: ১২ ডিসেম্বর ২০১৪ ০০:১০
Share:

এ পট মেদিনীপুরের পটুয়ারা আগে আঁকতেন না! কিন্তু হারিয়ে যাওয়ার প্রায় ৮০ বছর পরে মেদিনীপুরের পটুয়াদের হাত ধরে লুপ্তপ্রায় সেই পটই ফিরে পেয়েছে নতুন আঙ্গিক।

Advertisement

সাবেক কালীঘাটের পটচিত্রের অনুকরণে ফুটে ওঠে নানা ছবি— ‘মোহন্ত-এলোকেশী’, ‘বেড়াল তপস্বী’, ‘বাবু-বিবি’ কিংবা ‘বীণাবাদিনী’। এ ছবি আঁকছেন কারা? পশ্চিম মেদিনীপুরের পিংলার পটুয়ারা।

প্রখ্যাত শিল্প গবেষক ডব্লিউ জি আর্চার লিখেছিলেন,“বীরভূম ও মেদিনীপুরের পটুয়ারাই কালীঘাটের পটুয়াদের পূর্বপুরুষ।” সেই সূত্র ধরেই বলা যায়, মেদিনীপুরের পটুয়াদের সঙ্গে কালীঘাটের পটুয়াদের একটা যোগাযোগ ছিল। বীরভূম এবং মেদিনীপুরের পট হল মূলত গোটানো বা স্ক্রোল। আর কালীঘাটের পট হল চৌকো। লোকশিল্পের আঙ্গিক থেকে জনপ্রিয় শহুরে শিল্পধারায় উত্তরণই হল কালীঘাটের পটের বৈশিষ্ট্য। তবে বাংলার অন্যান্য পটের তুলনায় কালীঘাটের পটের জনপ্রিয়তার কারণ তার আটপৌরে সারল্য। সেখানে দেবদেবীও যেন প্রতিবেশী মানুষজনের মতো। অন্যান্য পটের মতো কেবলমাত্র ধর্মীয়, পৌরাণিক কিংবা ঐতিহাসিক বিষয়গুলির মধ্যে আবদ্ধ হয়ে থাকেনি কালীঘাটের পট। দেবদেবীর পাশাপাশি সে পটের মূল আকর্ষণ ছিল সামাজিক নানা ঘটনা, সামাজিক-নৈতিক অবক্ষয় এবং তৎকালীন সময়ের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। তা সে মোহন্ত-এলোকেশীর কেচ্ছাই হোক বা শ্যামাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঘের সঙ্গে লড়াইয়ের ঘটনা।

Advertisement

আগে মেদিনীপুরের পটুয়ারা আঞ্চলিক পট আঁকতেন। যেমন যাদুপট, সাঁওতালিপট, চক্ষুদানপট, দুর্গাপট, চণ্ডীমঙ্গলপট, গাজীপট ইত্যাদি। তবে একটু একটু করে গত এক দশক ধরে মেদিনীপুরের বেশির ভাগ পটুয়া আঞ্চলিক পটের পাশাপাশি কালীঘাটের পটের অনুকরণে ছবি আঁকছেন।

কেন এই অনুকরণ?

মেদিনীপুরের পটের তুলনায় বাজারে কালীঘাট-পটের চাহিদা বেশি। ‘এথনিক লুক’ বা ঘর সাজানোর উপকরণ হিসেবে কালীঘাট শৈলীর পটের চাহিদা আছে। তাই কলকাতা থেকে শুরু করে মফসসলের বিভিন্ন মেলায় মেদিনীপুরের পটশিল্পীরা আঞ্চলিক পটের পাশাপাশি কালীঘাটের পটের সম্ভার নিয়ে হাজির হন। পুরনো কালীঘাটের পট আজ দুর্লভ। আর পাওয়া গেলেও তার দাম আকাশছোঁয়া। তাই মেদিনীপুরের শিল্পীদের আঁকা কালীঘাটের পটের ভাল চাহিদা রয়েছে বাজারে। সম্প্রতি শুরু হওয়া রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় গত কয়েক বছরের মতো এ বারও দেখা গেল সেই পরিচিত ছবি। মেদিনীপুরের নানা রকম পটের মাঝে ক্রেতাদের বিশেষ পছন্দ কালীঘাটের পটচিত্র।

কালীঘাটের পুরনো পট

তেমনই এক জন পিংলার আনোয়ার চিত্রকর। আনোয়ার বললেন, “বছর কুড়ি আগে মেদিনীপুরের পটের সীমিত ক্রেতা ছিল। তাই নতুন কিছু আঁকার ইচ্ছে ছিল। এক দিন কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে কালীঘাটের পটের প্রতিরূপ দেখে অবাক হয়েছিলাম। তার পর থেকেই পুরনো কালীঘাট পটের কিছু ছবির সন্ধানে ছিলাম।” পরে ভারতীয় সংগ্রহালয় ও গুরুসদয় সংগ্রহালয়ে গিয়ে তিনি দেখেন আসল কালীঘাটের পট। কিছু বই কিনে সেই সব ছবির অনুকরণে ছবি আঁকা শুরু করলেন আনোয়ার। এ শহরের মেলাগুলিতে সেই সব ছবি ভালই বিক্রি হতে লাগল। বেশ কিছু মানুষ তাঁকে দিয়ে কালীঘাট সিরিজের উপর কাজ করিয়েছিলেন। পরে দিল্লি, মুম্বই প্রভৃতি জায়গায় আনোয়ারের আঁকা কালীঘাটের পটের প্রদর্শনী হয়েছে। ক্রমেই চাহিদা বাড়ছে এই পটের।বছর দশেক আগে পিংলার জনা কয়েক পটুয়াদের দিয়ে কলকাতার কয়েক জন শৌখিন মানুষ কালীঘাটের পটের অনুকরণে ছবি আঁকিয়েছিলেন। ব্যস! সেই থেকেই শুরু। মেদিনীপুরের দু-তিনজন পটুয়ার হাত ধরে শুরু হলেও, এখন বহু শিল্পী কালীঘাটের পটের অনুকরণে ছবি আঁকছেন।

আনোয়ার আরও জানালেন, শুধু পুরনো ছবির অনুকরণেই নয়, চারপাশের সাম্প্রতিক ঘটনা নিয়েও আঁকা হচ্ছে কালীঘাটের পট। তা সে ইজরায়েল-প্যালেস্তাইনে রাজনৈতিক সংঘর্ষ হোক বা লালগড়ে মাওবাদী হামলা কিংবা সারোগেট মাদার। সে কালের কালীঘাটের পটে ধরা পড়েছে সামাজিক নানা ঘটনা। তেমনই পিংলার সানোয়ার চিত্রকর বেশ কয়েক বছর ধরে কালীঘাট শৈলীতে এঁকে চলেছেন সাম্প্রতিক নানা বিষয়।

ইতিহাস অনুসারে, প্রায় ২০০ বছর আগে চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, মেদিনীপুর থেকে পটুয়ারা কালীঘাট অঞ্চলে এসেছিলেন। তারাই কালীঘাট মন্দির সংলগ্ন সব দোকানে পট এঁকে তীর্থযাত্রীদের কাছে বিক্রি করতেন। বাজারে লিথোগ্রাফি প্রিন্ট আসার পর থেকে বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে ক্রমেই হারিয়ে যেতে থাকে কালীঘাটের পট। কেন না পটের পরিবর্তে বাজারে জায়গা করে নিয়েছিল চকচকে পরিষ্কার ছাপা লিথোগ্রাফি প্রিন্ট। তবে দু’একজন শিল্পী কালীঘাটের পটুয়া পাড়ায় ধরে রেখেছিলেন সেই ঐতিহ্য। তাঁদেরই এক জন প্রয়াত শ্রীশচন্দ্র চিত্রকর। তাঁকে বলা হত কালীঘাটের শেষ পটুয়া। তাঁর মৃত্যুর পরে আঁধারেই তলিয়ে গিয়েছিল কালীঘাটের পটের ঐতিহ্য। তার পর প্রায় এক যুগ পরে, মেদিনীপুরের পটুয়ারা পুরনো সেই সব ছবির অনুকরণে নতুন ছবি আঁকতে শুরু করেন।

মেদিনীপুরের পটুয়াদের আঁকা কালীঘাট পট

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিউজিওলজি বিভাগের সহকারি অধ্যাপক তথা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের প্রাক্তন শিক্ষা আধিকারিক পিয়াসী ভরসা বলছিলেন, “বছর দুয়েক আগে ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল ও লন্ডনের ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়াম কালীঘাটের পটের এক প্রদর্শনীর আয়োজন করে। সেখানে তুলে ধরা হয়েছিল সে কালের পটের এক বিশাল সম্ভার। সঙ্গে ছিল মেদিনীপুরের শিল্পীদের আঁকা কিছু কালীঘাটের পট।” তিনি জানান, সে সব ছবিগুলি পাশাপাশি দেখলে বোঝা যায় যে, মেদিনীপুরের শিল্পীরা অনুসরণ করতে গিয়েই রপ্ত করে ফেলেছে কালীঘাট শৈলীর নানা খুঁটিনাটি বিষয়। মেদিনীপুরের পটুয়াদের কাজ কালীঘাটের পটুয়াদের থেকে আলাদা হলেও কালীঘাটের পট আঁকার সময় শিল্পীরা সেই পুরনো ধারাকেই বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। যেমন ছবিতে শেডের ব্যবহার এবং তুলির টানের সেই সাহসিকতা। পার্থক্য একটাই সে কালে কালীঘাটের পট আঁকা হত পাতলা কাগজে, এখন মেদিনীপুরের শিল্পীরা সেই পট আেঁকন আর্ট পেপারে। সেই কাগজের পিছনে আঠা দিয়ে কাপড় সাঁটা থাকে। পিয়াসীর কথায়, “সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, মেদিনীপুরের পট শিল্পীদের জন্যই হারিয়ে যাওয়া এই ঐতিহ্য নতুন একটা দিক খুঁজে পেয়েছে।”মেদিনীপুরের শিল্পীদের আঁকা কালীঘাটের পট নিয়ে বিশেষজ্ঞদের কী মত?

রাজ্য হস্তশিল্প মেলায় দেখা গেল হরেক পটের মাঝেও ক্রেতাদের মন কাড়ছে কালীঘাটের এই পট। পছন্দের পট বাছতে বাছতে নিউআলিপুরের শুভশ্রী রায় বলছিলেন, “মেদিনীপুরের শিল্পীদের আঁকা এই পট দেখতে সেকেলে কালীঘাটের পটের মতোই। পুরনো বিষয়ের পাশাপাশি কালীঘাটের পটে দেখা যাচ্ছে সাম্প্রতিক নানা ঘটনা। এই পট হল সাবেক ও আধুনিক বাঙালিয়ানার এক মেলবন্ধন।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন