Shatadru Dutta

রিষড়া থেকে রিও নিত্যযাত্রী ‘প্রভাবশালী’ শতদ্রুর হাতেখড়ি বাম আমলে, তবে ‘ক্রীড়ামন্ত্রী’ মদনকেও ঘোল খাইয়েছিলেন!

শতদ্রু হুগলির রিষড়ার ভূমিপুত্র। সেখানকার বাঙ্গুর পার্কের সামনে তাঁর আলিশান বাড়ি। যে বাড়ি মোড়া ১৮টি সিসি ক্যামেরায়। কম বয়সে রিষড়া লেনিন মাঠে নিয়মিত ক্রিকেট খেললেও ছোট থেকেই তিনি ফুটবলপ্রেমী।

Advertisement

আনন্দবাজার ডট কম সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৫ ডিসেম্বর ২০২৫ ১৮:৫০
Share:

ক্রীড়া সংগঠক শতদ্রু দত্ত। (ইনসেটে) রাজ্যের প্রাক্তন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্র। —ফাইল চিত্র।

যুবভারতী কেলেঙ্কারির ঘটনায় জনতার কাঠগড়ায় ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস। পরিস্থিতি এতটাই জটিল যে, অরূপের ইস্তফা নিয়েও জল্পনা শুরু হয়েছে। পাশাপাশিই তাঁর সঙ্গে তুলনা শুরু হয়েছে প্রাক্তন ক্রীড়ামন্ত্রী মদন মিত্রের। যাঁর আমলে যুবভারতীতে ফিফার ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’ খেলতে এসেছিল লিয়োনেল মেসি-সহ আর্জেন্তিনা। খেলতে এসেছিল ‘ব্রাজ়িল অলস্টার’।

Advertisement

দ্বিতীয় ম্যাচটির সময় যুবভারতী কেলেঙ্কারিতে ধৃত শতদ্রু দত্ত ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিলেন মদনকে! পরিস্থিতি এমনই পর্যায়ে গিয়েছিল যে, চুক্তিভঙ্গের দায়ে তৎকালীন ক্রীড়ামন্ত্রী গ্রেফতারও হয়ে যেতে পারতেন। ব্যক্তিগত চেষ্টাচরিত্র করে সে যাত্রায় মান বেঁচেছিল মদনের। সে ঘটনা প্রশাসন এবং রাজনীতির অন্দরমহলে অনেকেরই জানা। যুবভারতীর কেলেঙ্কারির পরে সে ইতিহাস ঘুরে আসছে ওয়াকিবহাল মহলে।

মদন অবশ্য মুখে কুলুপ এঁটেছেন। দু’তিন লাইনের মন্তব্য করেছেন শুধু। তার মধ্যে ‘বিস্ফোরক’ কিছু নেই। স্বাভাবিক। তৃণমূলের অন্দরে মদনের অবস্থান এখন খানিক নড়বড়ে। এই পরিস্থিতিতে ‘বিতর্কিত’ কিছু বললে সে অবস্থান আরও দুর্বল হবে। মদন তা-ই বিস্তারিত মন্তব্য এড়িয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু ১৩ বছর আগের ঘটনা এখন লোকমুখে আবার ঘুরতে শুরু করেছে। ঘুরছে তখন যাঁরা ক্রীড়া দফতরে কাজ করতেন, তাঁদেরও ঘনিষ্ঠমহলে।

Advertisement

সেই ঘটনা বলছে, ১৩ বছর আগে ২০১২ সালে শতদ্রুর উদ্যোগেই কলকাতায় এসেছিল ‘ব্রাজিল অলস্টার’। সেই দলে ছিলেন ১৯৯৪ সালের বিশ্বকাপজয়ী ব্রাজিল দলের সাত খেলোয়াড়। ছিলেন অধিনায়ক দুঙ্গা, বেবেতো, মাউরো সিলভা, ব্র্যাঙ্কোর মতো ফুটবলারেরা। ২০০২ বিশ্বকাপজয়ী দলেরও জনা তিনেক সদস্য ছিলেন সেই দলে। তাঁদের বিরুদ্ধে প্রাক্তন ভারতীয় ফুটবলারদের প্রদর্শনী ম্যাচ ছিল যুবভারতীতে। সেই ম্যাচেও প্রায় ৫০ হাজার লোক হয়েছিল। অধিকাংশ দর্শকই টিকিট কেটে খেলা দেখতে এসেছিলেন।

ম্যাচ ছিল এমনই ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখে। যুবভারতীর গ্যালারি প্রায় ভরে গিয়েছিল। কিন্তু দেখা যায়, নির্ধারিত সময় পেরিয়ে যাওয়ার পরেও ব্রাজ়িলের টিম মাঠে নামছে না। পরিস্থিতি ক্রমেই ঘোরালো হচ্ছিল। মদন তখন যুবভারতীতে ক্রীড়ামন্ত্রীর জন্য নির্দিষ্ট ঘরে বসে। তিনিও লক্ষ করেন, টিম নামছে না। সেই সময়েই তাঁর কাছে প্রশাসনের উপরমহল থেকে ফোন আসে। বলা হয়, টিম হায়াত রিজেন্সি হোটেল ছেড়ে মাঠে আসেনি। পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। টিম না নামলে রাজ্য সরকারকে বেকায়দায় পড়তে হবে। মনে রাখতে হবে, তৃণমূল সরকার তখন মাত্রই দেড় বছর হল রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছে। এমন একটা সময়ে সরকারের ‘বদনাম’ হওয়া খুব ভাল ঘটনা হত না। তার আগে ২০১১ সালের ২ সেপ্টেম্বর আর্জেন্তিনা-ভেনেজ়ুয়েলা ‘ফ্রেন্ডলি ম্যাচ’ ভাল ভাবে উতরে গিয়েছিল। ফলে কলকাতা যে আন্তর্জাতিক মানের খ্যাতনামীদের সামলাতে পারে, সেই ধরনাও তৈরি হয়েছিল। ব্রাজ়িল অলস্টার মাঠে না নামলে তাতেও চুনকালি পড়ত।

মদনের এক ঘনিষ্ঠের কথায়, ‘‘শতদ্রু দত্তকে ডেকে দাদা জানতে চান, কী হয়েছে। শতদ্রু দাদাকে বলে, চুক্তি অনুযায়ী ব্রাজ়িল দলের ভারতীয় মুদ্রায় দু’কোটি টাকা বকেয়া আছে। সেই টাকা না-পেলে টিম হোটেল থেকে মাঠেই আসবে না। মাঠে নামার তো প্রশ্নই নেই।’’ মদন আরও জানতে পারেন, শতদ্রু ব্রাজ়িল অলস্টার দলের ম্যানেজারকে বলেছেন, মদন রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী। টাকাপয়সার ব্যাপারে তিনিই যা করণীয় করবেন। তাঁর উপরেই বিষয়টা নির্ভর করছে। মদনের ওই ঘনিষ্ঠের দাবি, ‘‘দাদা তখনও পর্যন্ত টাকাপয়সা বা চুক্তির কথা কিছুই জানতেন না।’’

অথৈ জলে পড়েন ক্রীড়ামন্ত্রী। এক দিকে রাজ্যের সম্মান। অন্য দিকে চুক্তিভঙ্গের বিপদ। তার উপর যুবভারতীর ক্ষোভ। অনন্যোপায় হয়ে মদন ব্রাজ়িল টিমের ম্যানেজারকে জানান, টিম মাঠে এসে খেলতে নামুক। তিনি ভারতীয় মুদ্রায় ওই টাকা যোগাড় করে দেবেন। কিন্তু তাতে ব্রাজ়িলের ম্যানেজার রাজি হননি। তিনি বলেন, পুরো বকেয়া অর্থ মেটাতে হবে মার্কিন ডলারে!

ঘটনাচক্রে, ২০১২ সালের ৮ ডিসেম্বর ছিল রবিবার। ফলে ভারতীয় মুদ্রাকে বিদেশি মুদ্রায় পরিবর্তন করার উপায় ছিল না। শেষ পর্যন্ত মদনের মৌখিক প্রতিশ্রুতিতেই ব্রাজ়িল অলস্টার মাঠে নামতে রাজি হয়। কিন্তু একই সঙ্গে ক্রীড়ামন্ত্রীকে জানানো হয়, বকেয়া টাকা না-পাওয়া পর্যন্ত তাঁরা ভারতেই তাঁবু খাটিয়ে বসে থাকবেন এবং ক্রীড়ামন্ত্রীর বিরুদ্ধে পুলিশে চুক্তিভঙ্গের অভিযোগ করবেন। মদন-ঘনিষ্ঠের কথায়, ‘‘ওরা বলেছিল, উই উইল ক্যাম্প ইন ইন্ডিয়া!’’ তাঁর বক্তব্য, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে মদন সেই টাকা জোগাড় করেছিলেন এবং চুক্তিভঙ্গের দায় থেকে রেহাই পেয়েছিলেন। যদিও রাজ্য সরকার বা রাজ্যের ক্রীড়া দফতরের উদ্যোগে সেই দলকে কলকাতায় আনা হয়নি।

তার পর থেকে মদন আর শতদ্রুর সঙ্গে কোনও সংশ্রব রাখেননি। তবে বর্তমান ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ ওই ঘটনা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন।

শতদ্রুর ‘ইভেন্ট’ জগতে হাতেখড়ি বাম আমলে হলেও ‘প্রভাবশালী’ হন তৃণমূলের জমানাতেই। তবে তিনি ‘কাজ’ করেন শুধু বিশ্বখ্যাত ফুটবলারদের নিয়েই। এই ধরনের যে কোনও ব্যবসায়ীই সমাজের বিভিন্ন স্তরের কেষ্টুবিষ্টুকে ‘নৈবেদ্য’ দিয়ে বশ করে রাখেন। শতদ্রুর ক্ষেত্রে তা ছিল এই ধরনের ম্যাচ বা ইভেন্টের গোছা গোছা ভিআইপি পাস এবং খ্যাতনামীর আশেপাশে ঘুরঘুর করার আমন্ত্রণ, ছবি তোলার সুযোগ। নামী মুখ, পরিচিত ব্যক্তি, রাজনৈতিক দলগুলির নীতিনির্ধারকদের কাছে পৌঁছে যেত টিকিটের গোছা। তবে এখন টিকিট নিতে তাঁর কাছে যেতে হয়। যে কারণে শুক্রবার রাত পর্যন্তও এই শ্রেণির অনেকে হায়াত রিজেন্সিতে তাঁর কাছে হত্যে দিয়ে পড়ে থেকেছেন। বস্তুত, এঁদের অনেকে মেসির সফর চূড়ান্ত হওয়ার পর থেকেই শতদ্রুর সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। গত দু’মাস তাঁরা প্রায় ব্যাকপ্যাকের মতো শতদ্রুর ঘাড়ে পড়ে থেকেছেন। এ অবশ্য প্রত্যাশিতই যে, শতদ্রু গ্রেফতার হওয়ার পর তাঁরা শতদ্রুকে দ্রুত হাত থেকে ফেলে দিয়েছেন। এতটাই যে, বিপন্ন শতদ্রুর ঘনিষ্ঠ লোকজন ফোন করলে সেই ফোনও ধরছেন না!

শতদ্রুকে অনেকেই বলে থাকেন ‘ওয়ান ম্যান আর্মি’। সেই একক সেনার ‘প্রভাব’ এবং ‘ক্ষমতা’ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, মেসির সফরের ২৪ ঘন্টা আগে তিনি দুপুর থেকে বিকাল পর্যন্ত চার ঘণ্টা ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপকে যুবভারতীতে বসিয়ে রেখেছিলেন! বারবার ফোন করলেও ধরেননি বলে অভিযোগ। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, শুক্রবারেই বিরক্ত অরূপ শতদ্রুকে বলেছিলেন, এই ধরনের অনুষ্ঠান এই শেষ বার। আর করতে দেওয়া হবে না! ঘটনাপ্রবাহও সেই দিকেই গেল। যদিও একেবারে অন্য কারণে।

এমনিতে শতদ্রু হুগলির রিষড়ার ভূমিপুত্র। সেখানকার বাঙ্গুর পার্কের সামনে তাঁর আলিশান বাড়ি। যে বাড়ি মোড়া ১৮টি সিসি ক্যামেরায়। কম বয়সে রিষড়া লেনিন মাঠে নিয়মিত ক্রিকেট খেললেও ছোট থেকেই শতদ্রু ফুটবলপ্রেমী। দিয়েগো মারাদোনার এমনই ভক্ত যে, পুত্রের নাম রেখেছেন ‘দিয়েগো’। রিষড়ার মানুষ শতদ্রুকে ‘রনি’ নামেই চেনেন। এই রনির ইভেন্টের জগতে হাতেখড়ি তাঁর জামাইবাবু অশেষ দত্তের সূত্রে। কিন্তু ক্রমে অশেষকে টপকে শ্যালক হয়ে ওঠেন অপ্রতিরোধ্য। মূলত খেলার ইভেন্টেই তাঁর ঝোঁক বাড়তে থাকে। সমান্তরাল ভাবে বাড়তে থাকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা। যে ঘনিষ্ঠতা তাঁকে এগোতে সাহায্যই করেছে বলে ময়দান এবং রাজনৈতিক মহলের বক্তব্য। প্রসঙ্গত, শনিবার যুবভারতীতে মেসি-সফরে সৌরভও আমন্ত্রিত ছিলেন। তবে দর্শক ক্রোধের চোটে তিনি মেসির কাছাকাছি পৌঁছোতেও পারেননি। বস্তুত, সৌরভ ঢোকার আগেই মেসি বেরিয়ে গিয়েছিলেন।

রিষড়ায় শতদ্রুর কৈশোরের যে বন্ধুমহল, সেখানে তিনি প্রায়শই শ্লাঘা নিয়ে বলতেন, ‘‘আমি রিষড়া থেকে রিও (ব্রাজিলের প্রাক্তন রাজধানী শহর) ডেলি প্যাসেঞ্জারি করতে পারি!’’ আপাতত তিনি বিধাননগর পুলিশের হেফাজতে। সেখানেই আরও ১২টি দিন কাটাতে হবে তাঁকে। একাকী সৈন্যের বাহিনী আপাতত ব্যারাকে!

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement