Carpenter

রোবোটিক হাত দিয়েই জীবনযুদ্ধে ঝাঁপাতে চান ইন্দ্রজিৎ

দুর্ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন পেশায় কাঠের মিস্ত্রি ইন্দ্রজিৎ।

Advertisement

প্রসেনজিৎ সাহা

ক্যানিং শেষ আপডেট: ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২২ ১০:০৬
Share:

লড়াকু: রোবোটিক হাতের সাহায্যে জল খাচ্ছেন ইন্দ্রজিৎ। নিজস্ব চিত্র

সালটা ২০২০। করোনার প্রকোপ চলছে দেশ জুড়ে। লকডাউনের জেরে স্বাভাবিক জীবন বিপর্যস্ত। সে সময়ে বসিরহাটের বিভিন্ন প্রান্তে করোনা আক্রান্ত রোগীদের বাড়িতে কখনও অক্সিজেন সিলিন্ডার, কখনও বা খাবার নিয়ে ছুটে গিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দা ইন্দ্রজিৎ চৌধুরী (অলোক)। কারও কোনও বিপদের কথা শুনলেই বাড়িয়ে দিয়েছেন সাহায্যের হাত।

Advertisement

কিন্তু সে বছরই জুন মাসে ইলেকট্রিক তারে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে খোয়া যায় তাঁর হাত দুটো। নিজের দু’টি পায়ে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও হারিয়ে ফেলেন বছর তেতাল্লিশের ইন্দ্রজিৎ।

ধীরে ধীরে হতাশা গ্রাস করছিল তাঁকে। সে সময়ে কয়েকজনকে পাশে পান ইন্দ্রজিৎ। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের উদ্যোগে দীর্ঘদিন লড়াইয়ের পরে দু’টি রোবোটিক হাত পেয়েছেন ইন্দ্রজিৎ। ধীরে ধীরে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর চেষ্টাও করছেন। নতুন করে জীবনযুদ্ধের লড়াইয়ে ফিরতে চান ইন্দ্রজিৎ।

Advertisement

দুর্ঘটনার কথা মনে পড়লে এখনও শিউরে ওঠেন পেশায় কাঠের মিস্ত্রি ইন্দ্রজিৎ। জানালেন, ২০২০ সালের ৪ জুন কাজের সূত্রে বসিরহাট এলাকায় গিয়েছিলেন। তিনতলায় বাঁশের মাচায় উঠে কাজ করছিলেন। হঠাৎই পাশে থাকা ১১ হাজার ভোল্টের ইলেকট্রিক তারের সংস্পর্শে এসে ছিটকে পড়ে ঝুলতে থাকেন তিনি।। বাঁশ দিয়ে ধাক্কা মেরে ওই উঁচু মাচা তাঁকে নীচে ফেলেন স্থানীয় বাসিন্দারা। ঘটনার অভিঘাতে সারা শরীর ঝলসে যায়।

সঙ্কটজনক অবস্থায় তাঁকে প্রথমে বসিরহাট মহকুমা হাসপাতাল ও পরে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। প্রায় সাতদিন বাদে জ্ঞান ফেরে ইন্দ্রজিতের। তিনি বলেন, ‘‘জ্ঞান ফিরলে দেখি, কনুইয়ের নীচ থেকে বাঁ হাতটা আর নেই। মানসিক ভাবে ভেঙে পড়লেও ভেবেছিলাম ডান হাতটা দিয়ে বাকি জীবনটুকু চালিয়ে নেব। কিন্তু প্রাণ বাঁচাতে ডান হাতটিকেও বাদ দেন চিকিৎসকেরা।’’

শুধু তাই নয়, পায়ের বেশ কিছুটা অংশের মাংস পচে গিয়েছিল তাঁর। মাথার খুলিতে সংক্রমণ-সহ আরও নানা সমস্যায় ভুগতে শুরু করেন। সাতবার অস্ত্রোপচার করতে হয় শরীরের বিভিন্ন অংশে।

দরিদ্র পরিবারের একমাত্র রোজগেরে ইন্দ্রজিতের এ হেন পরিস্থিতিতে গোটা পরিবার কার্যত অসহায় হয়ে পড়ে। মা সুচিত্রা চৌধুরী সংসার চালানোর জন্য হোটেলে রান্নার কাজ নেন। স্ত্রী সুষমা স্বামীর দেখভালের কাজ শুরু করেন। ইন্দ্রজিৎ বলেন, ‘‘খুব হতাশ হয়ে পড়েছিলাম। কী করব, বুঝে উঠতে পারছিলাম না।’’

২০২১ সালের গোড়াতেই ইন্দ্রজিৎয়ের কথা জানতে পারে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটি। তারই এক সদস্য জয়ন্ত চক্রবর্তী ইন্দ্রজিৎকে বসিরহাট থেকে কলকাতায় নিয়ে যান। বেশ কিছুদিন সেখানে চিকিৎসা চলে। কিন্তু সে ভাবে কোনও উন্নতি হয়নি। এরপরে হায়দরাবাদের রোবট অর্থকেয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ হয় ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার। ইন্দ্রজিৎকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানকার চিকিৎসকেরা জানান, ইন্দ্রজিতের জন্য রোবোটিক হাতের ব্যবস্থা করা সম্ভব। সেই হাতের সাহায্যে ১০০ শতাংশ না হলেও নিজের অনেক কাজই করতে পারবেন তিনি।

ইন্দ্রজিৎ বলেন, ‘‘ডাক্তারের কথায় যেন নতুন করে আশার আলো দেখতে পেলাম। আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম সেদিন।’’

ওই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সদস্য পৌষালি বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, হায়দরাবাদে যাওয়ার ট্রেনের টিকিট পাওয়ার কথা শুনে ফোনের ওপার থেকে ইন্দ্রজিৎ বলেছিলেন, ‘আমি সত্যি আবার আবার নিজের হাতে জলের গ্লাসটা মুখে তুলতে পারব!’

বহু বাধা পেরিয়ে অবশেষে কৃত্রিম দু’টো হাত পেয়েছেন ইন্দ্রজিৎ। দিন কয়েক আগে হায়দরাবাদ থেকে কলকাতায় ফেরেন। সড়গড় হয়ে উঠছেন নতুন হাতের সঙ্গে। ইতিমধ্যে বার কয়েক নিজেই জলের গ্লাস তুলে জল খেয়েছেন। লেখালিখি, ফোন ধরার মতো কাজও করতে পারছেন বলে জানালেন। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ব্যবহার করতে করতেই আরও অনেক কাজই তিনি নতুন হাত দিয়ে করতে পারবেন। আগামী কয়েক মাস চিকিৎসকদের দেখানো ব্যায়াম করলে নিজের পায়ে চলাফেরাও করতে পারবেন।

কলকাতায় ফিরে ফোনে ইন্দ্রজিৎ বলেন, ‘‘দুর্ঘটনার পরে ভাবতাম, এই জীবন নিয়ে বেঁচে থাকা যায় না। কিন্তু ওই সংস্থার লোকজন আমাকে নতুন ভাবে বাঁচতে শিখিয়েছেন। এই লড়াই আমি জিতবই।’’

দীর্ঘদিন বাদে স্বামীর মুখে হাসি দেখে খুশি সুষমা। তিনি বলেন, ‘‘প্রায় দু’বছর ধরে ওঁর চোখে শুধু জল দেখেছি। হাত ফিরে পেয়ে খুব খুশি উনি। আমরাও সকলে খুব আনন্দিত। বিপদের সময়ে যাঁরা পাশে ছিলেন, তাঁদের কৃতজ্ঞতা জানাই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন