অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। — ফাইল চিত্র।
তিন সপ্তাহ। সাত সাংগঠনিক জেলা। মোট বিধানসভা আসন ৪৪টি। যার মধ্যে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে তৃণমূলের দখলে ছিল ২৪টি। কিন্তু গত লোকসভার নিরিখে তা নেমে এসেছে ২০-তে। উত্তরবঙ্গের সেই ‘ক্ষত’ মেরামত করতে জেলা ধরে ধরে নির্দেশ দিয়েছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। লক্ষ্য একটাই— ২০২৬ সালে নীলবাড়ির লড়াইয়ে উত্তরবঙ্গের মাটিতে আরও ঘাসফুল ফোটাতে হবে।
সপ্তাহ তিনেক আগে কোচবিহার জেলা দিয়ে যে ‘রোগনির্ণয়’ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা শেষ হয়েছে গত মঙ্গলবার দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা দিয়ে। ক্যামাক স্ট্রিটে অভিষেকের দফতরে সমস্ত জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে বৈঠকে অভিষেকের সঙ্গে ছিলেন প্রবীণ নেতা তথা রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সীও। তৃণমূল সূত্রের খবর, বিধানসভা ভোটের জন্য প্রত্যেক জেলাকে পৃথক পৃথক বার্তা দিয়েছেন অভিষেক। তবে সব জেলার ক্ষেত্রে একটি অভিন্ন বার্তাও রয়েছে— ভোটার তালিকায় বিশেষ নিবিড় সমীক্ষার প্রস্তুতি হিসাবে বুথ কামড়ে পড়ে থাকতে হবে।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলকে শূন্য করে দিয়েছিল বিজেপি। দু’বছর পরে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সেই উত্তরে বিজেপির দাপটের মধ্যেও বিক্ষিপ্ত আসন জিতেছিল তৃণমূল। বিশেষত, মালদহে আশাতীত ফল করেছিল মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল। গত লোকসভায় উত্তর থেকে শূন্যহাতে ফিরতে হয়নি তৃণমূলকে। তবে উত্তরবঙ্গ যে তৃণমূলের জন্য এখনও ‘শক্ত মাটি’, তা মানেন শাসকদলের প্রায় সকলে। উত্তরবঙ্গে গত কয়েকটি ভোটের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে দেখা যাচ্ছে, সেখানে তৃণমূলের জন্য ভাল, মন্দ দুই’ই রয়েছে। কোথাও হারের ক্ষতে প্রলেপ পড়েছে। আবার কোথাও ২০২১ সালের জয় ধরে রাখা যায়নি ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটে।
উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের ৯টি সাংগঠনিক জেলা রয়েছে। তার মধ্যে গুরুত্বের বিচারে ৭টি তৃণমূলের জন্য উল্লেখযোগ্য। সেই তালিকায় রয়েছে কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং (সমতল), দুই দিনাজপুর এবং মালদহ। এই সাতটি সাংগঠনিক জেলায় মোট বিধানসভা আসন ৪৪। দার্জিলিং (পার্বত্য) এবং কালিম্পংয়ের বৈঠক এখনও হয়নি। পরে তা হতে পারে। তৃণমূলের অনেকের মতে, পাহাড়ের দু’টি জেলায় রাজনৈতিক সমীকরণ ভিন্ন। সেখানে তৃণমূল একক ভাবে কিছু করে ফেলবে, তেমন শক্তি এখনও অর্জিত হয়নি। তা ছাড়াও পাহাড়ের রাজনীতিতে জাতিগত এবং স্থানীয় নানা সমীকরণ রয়েছে। ফলে সেই দু’টি জেলাকে আপাতত বৈঠকের বাইরে রাখা হয়েছে।
ক্যামাক স্ট্রিট সূত্রের খবর, সব জেলাকেই সরকারি প্রকল্পকে প্রচারের ‘হাতিয়ার’ করতে বলেছেন অভিষেক। যে জেলায় লোকসভায় খারাপ ফল হয়েছে, সেখানকার নেতৃত্বকে প্রশ্ন করেছেন, সরকার কাজ করছে অথচ ভোটে খারাপ ফল কেন? সব বৈঠকেই বুথ, বিধানসভা এমনকি, ব্লকভিত্তিক ফলাফলের পরিসংখ্যান হাতে নিয়েই বসেছিলেন অভিষেক। তৃণমূলে সকলেই জানেন, তাঁদের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের রাজনীতির ঘরানা ভিন্ন। তিনি বহুজাতিক সংস্থার ধাঁচে পরিসংখ্যান নিয়ে পরিকল্পনা করেন। ওই বৈঠকগুলিতেও তেমনই হয়েছে। কোন বুথে ৫০-এর কম ভোটে হার, কত বুথে তৃণমূল পিছিয়ে ১০০-র কম ভোটে, তা বিশদে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট জায়গায় সাংগঠনিক মনোনিবেশের নির্দেশ দিয়েছেন অভিষেক।
তৃণমূলের অনেকের বক্তব্য, গত কয়েক বছরে নানা ভাবে উত্তরবঙ্গে সংগঠনে গতিশীলতা বেড়েছে। গত বিধানসভা ভোটের পর থেকে এখনও পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী মমতা অন্তত ১৫ বার উত্তরবঙ্গের জেলায় জেলায় সফর করেছেন। উপনির্বাচনে জলপাইগুড়ির ধূপগুড়ি এবং আলিপুরদুয়ারের মাদারিহাট আসন বিজেপির থেকে ছিনিয়ে নিতে পেরেছে তৃণমূল। তবে একাধিক জেলায় যে ‘ত্রুটি’ রয়েছে, তা-ও চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন অভিষেক।
কোচবিহার
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল থেকে বিজেপিতে গিয়ে কোচবিহার লোকসভা আসনে পদ্ম ফুটিয়েছিলেন নিশীথ প্রামাণিক। তাঁকে কেন্দ্রে প্রতিমন্ত্রী করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। দেওয়া হয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের ‘ডেপুটি’র দায়িত্ব। ২০২৪ সালে সেই কোচবিহারে সেই নিশীথকেই হারিয়েছে তৃণমূল। কোচবিহারের বৈঠকে অভিষেক বলেছেন, লোকসভার ফলাফল ধরে রাখতে হবে বিধানসভা ভোটেও। কোচবিহার জেলায় মোট বিধানসভা আসন ৯টি। ২০২১ সালে তার মধ্যে ৩টিতে জিতেছিল তৃণমূল। ৬টি বিজেপি। গত লোকসভার নিরিখে ৫টি বিধানসভায় এগিয়ে তৃণমূল। অর্থাৎ, সেখানে বৃদ্ধি হয়েছে শাসকদলের। তবে বুথস্তরের সংগঠনে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার নির্দেশ পেয়েছেন জেলার নেতৃত্ব। সীমান্তবর্তী এলাকাতেও সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছেন অভিষেক।
জলপাইগুড়ি
২০১৯ সালের পরে ২০২৪ সালে জলপাইগুড়ি লোকসভা আসন বিজেপি ধরে রাখলেও জয়ের ব্যবধান প্রায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। ২০১৯ সালে বিজেপি জিতেছিল প্রায় দু’লক্ষ ভোটে। সেটা গত লোকসভায় নেমে দাঁড়ায় এক লক্ষের কম। জলপাইগুড়ি লোকসভায় ৫ শতাংশ ভোটও বেড়েছে তৃণমূলের। এই জেলার ৭টি বিধানসভার মধ্যে ২০২১ সালে তৃণমূল জিতেছিল ৩টিতে। পরে উপনির্বাচনে ধূপগুড়ি জেতে তারা। বিজেপির রয়েছে ৪টি আসন। জলপাইগুড়ির এক তৃণমূল বিধায়কের বক্তব্য, বৈঠকে অভিষেক ব্লক ধরে ধরে ত্রুটি চিহ্নিত করে কয়েক মাসের কাজ বলে দিয়েছেন। রাজবংশী এবং জনজাতিদের মধ্যে সরকারের পরিষেবামূলক প্রকল্পগুলির প্রচারে জোর দিতে বলা হয়েছে।
আলিপুরদুয়ার
২০২১ সালের নির্বাচনে এই জেলায় পাঁচে-পাঁচ পেয়েছিল বিজেপি। তবে তৃণমূলের সাংগঠনিক কাজে ধারাবাহিকতা রয়েছে আলিপুরদুয়ারে। বিজেপির দখলে থাকা মাদারিহাট আসন উপনির্বাচনে জিতেছে তারা। আবার আলিপুরদুয়ার বিধানসভায় বিজেপির টিকিটে জেতা সুমন কাঞ্জিলাল তৃণমূলের সঙ্গেই রয়েছেন গত কয়েক বছর। শাসকদলে যোগ দিয়েছেন প্রাক্তন বিজেপি সাংসদ তথা প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জন বার্লাও। খ্রিষ্টান ভোটের কিয়দংশে যাঁর প্রভাব রয়েছে বলে অনেকের বক্তব্য। তৃণমূল সূত্রের খবর, আলিপুরদুয়ারের চা বলয়ে দলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি-র কাজে আপাতত সন্তুষ্ট অভিষেক। তবে বিধানসভা ভোটের আগে বুথেই মনোনিবেশ করতে বলা হয়েছে নেতাদের। তৃণমূলের আশা, আলিপুরদুয়ারে খেলা ঘুরবে।
দার্জিলিং (সমতল)
তৃণমূল সূত্রের বক্তব্য, জেলার নেতৃত্বের কাজে সন্তুষ্ট নন অভিষেক। বৈঠকে ধারাবাহিক নির্বাচনী বিপর্যয় নিয়ে অসন্তোষও প্রকাশ করেছেন তিনি। দার্জিলিং (সমতল) সাংগঠনিক জেলায় বিধানসভা আসন ৩টি। সব ক’টিই বিজেপির দখলে। মাটিগাড়া-নকশালবাড়ি এবং ফাঁসিদেওয়াতে এখনও অবধি ঘাসফুল ফোটেনি। শিলিগুড়িতে তৃণমূল শেষ জিতেছিল ২০১১ সালে। কেন এই ধারাবাহিক ব্যর্থতা, বৈঠকে সেই প্রশ্ন উঠেছে। পুরনো কর্মীদের দূরে সরিয়ে রাখার প্রবণতা ত্যাগ করতে বলা হয়েছে নেতৃত্বকে।
উত্তর দিনাজপুর
২০১৯ সালে রায়গঞ্জ লোকসভা আসন প্রথম জিতেছিল বিজেপি। ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সেই ক্ষত মেরামত করে তৃণমূল। জেলার ৯টি বিধানসভার মধ্যে তৃণমূল জেতে ৭টি। রায়গঞ্জ আর কালিয়াগঞ্জ জিতেছিল বিজেপি। কিন্তু ২০২৪ সালে বিজেপি আবার লোকসভায় জেতে। উত্তর দিনাজপুরের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে রায়গঞ্জ শহরের ফলাফল নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন অভিষেক। পাশাপাশি ইটাহার, চোপড়ার মতো এলাকার সংগঠনের প্রশংসাও করেছেন। ইসলামপুরের বিধায়ক আব্দুল করিম চৌধুরী কয়েক মাস অন্তর বিতর্কিত মন্তব্য করে দলকে অস্বস্তিতে ফেলেন। নির্দিষ্ট প্রসঙ্গের উল্লেখ না করলেও অভিষেক বার্তা দিয়েছেন, সংবাদমাধ্যমের সামনে আলটপকা মন্তব্য না-করতে। জেলা নেতাদের নিজেদের মধ্যে বিবাদও মিটিয়ে নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।
দক্ষিণ দিনাজপুর
এই জেলার বালুরঘাট লোকসভায় ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির সুকান্ত মজুমদার জিতেছিলেন ৩৩ হাজার ভোটে। সেই ব্যবধান ২০২৪ সালে কমে হয় ১০ হাজারের সামান্য বেশি। বিজেপি এবং তৃণমূলের প্রাপ্ত ভোটের ফারাক ১ শতাংশেরও কম। দক্ষিণ দিনাজপুরের বৈঠকে জেলা নেতৃত্বের সামনে পরিসংখ্যান তুলে ধরে অভিষেক বলেছেন, কী ভাবে নাকের ডগা দিয়ে এই আসনটি ফস্কে গিয়েছে। বলেছেন, দলের নেতারা আরও ‘সিরিয়াস’ হলে বালুরঘাট তৃণমূল জিততে পারত। বিধানসভা ভোটের আগে গা ঝাড়া দিয়ে ময়দানে নামার নির্দেশ দিয়েছেন অভিষেক। এই জেলায় মোট বিধানসভা আসন ৬টি। ২০২১ সালে তিনটি করে আসন জিতেছিল তৃণমূল এবং বিজেপি।
মালদহ
২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে মালদহে শোচনীয় ফলাফল হয়েছিল তৃণমূলের। ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে মালদহ উত্তর লোকসভা জেতে বিজেপি। মালদহ দক্ষিণ কংগ্রেস। কিন্তু ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটে সেই ধাক্কা সামলে নেয় তৃণমূল। ১২টির মধ্যে ৮টি আসনই জেতে ঘাসফুল। মালদহে প্রচারে গিয়ে মমতা বলেছিলেন, ‘‘এ বার আমার আম, আমসত্ত্ব সব চাই।’’ কিন্তু ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও মালদহের দু’টি আসনেই হারে তৃণমূল। মালদহের তৃণমূলে গোষ্ঠীকোন্দল সুবিদিত। সেই লড়াইয়ে খুনোখুনি পর্যন্তও হয়েছে। অভিষেক মালদহের নেতাদের গোষ্ঠীকোন্দল দ্রুত মিটিয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। অভিষেকের ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, তিনি মনে করেন মালদহের খারাপ ফলাফলের জন্য গোষ্ঠীকোন্দলই দায়ী। মালদহে মেরুকরণের আবহও চরমে পৌঁছেছে। সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে অভিষেক নির্দেশ দিয়েছেন বুথের সংগঠনে মনোযোগী হতে। ‘দোদুল্যমান’ নেতৃত্বকে সরানোর বার্তাও দিয়েছেন তিনি।