উত্তরপ্রদেশে মোদী-ঝড়ের পরে সপ্তাহও ঘোরেনি, চিট ফান্ড তদন্তে গতি বাড়িয়েছে সিবিআই। তৃণমূলে রক্তচাপ বাড়িয়ে এ বার নেমে এল নারদ-খাঁড়াও। শুক্রবার নারদ ঘুষ কাণ্ডের তদন্ত সিবিআইয়ের হাতে তুলে দিল কলকাতা হাইকোর্ট। রাজ্যকে ভর্ৎসনা করে আদালত সাফ বলল, তদন্তে আর দেরি করা যাবে না। ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই দায়িত্ব বুঝে নিতে হবে সিবিআইকে। প্রাথমিক তদন্ত করে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে রিপোর্ট জমা দিতে হবে তাদের।
গত বিধানসভা ভোটের ঠিক আগে একটি ‘স্টিং অপারেশন’ ফাঁস করেছিল নারদ নিউজ নামে এক সংস্থা। গোপন ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গিয়েছিল, নারদের কর্ণধার ম্যাথু স্যামুয়েলের থেকে নগদ টাকা নিচ্ছেন মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক মিলিয়ে তৃণমূলের প্রায় এক ডজন নেতা। শোভন চট্টোপাধ্যায়, ফিরহাদ হাকিম, মুকুল রায়, শুভেন্দু অধিকারী, সুলতান আহমেদ থেকে বর্ষীয়ান সৌগত রায়কেও দেখা যায় ফুটেজে। এ ছাড়া, টাকা নিতে দেখা যায় পুলিশকর্তা সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জাকে।
আরও পড়ুন: আপাতত স্বস্তিতে নারদ-কর্তা
ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিশীথা মাত্রে এবং বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এ দিন রায় ঘোষণার সময়ে বলেন, ‘‘প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে, ভিডিও ফুটেজ বিকৃত করা হয়নি। ম্যাথু স্যামুয়েল ভাল বা মন্দ হতে পারেন। তার মানে এই নয় যে, অভিযুক্তরা ছাড় পেয়ে যাবেন। বরং যাঁরা সরকারি পদে রয়েছেন, তাঁদের আচরণ সন্দেহজনক হলে বা তাঁদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তা গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকারক।’’ বিচারপতিরা বলেন, এ ক্ষেত্রে রাজ্য সরকার স্বাধীন ভাবে কাজ করেনি। উল্টে অভিযুক্তদের সর্বশক্তি দিয়ে সমর্থন করেছে। যা দেখে আদালতও বিস্মিত। তা ছাড়া অভিযুক্তদের হাতে রাজ্য পুলিশ যে ভাবে পুতুলের মতো নেচেছে তা দুর্ভাগ্যজনক।
শাসক দলের তরফে অবশ্য বলা হচ্ছে, এমন রায়ের জন্য মানসিক প্রস্তুতি ছিল। রাজনৈতিক ও আইনি— দু’ভাবেই এই ‘সংকট’-এর মোকাবিলা করা হবে। সরকার ও তৃণমূল যে এই রায়কে সুপ্রিম কোর্টে চ্যালেঞ্জ করবে, তা এ দিন জানিয়েছেন মমতাও। যদিও সর্বোচ্চ আদালতে গেলে কতটা রেহাই পাওয়া যাবে তা নিয়ে সংশয় রয়েছে তৃণমূলেও। একে তো সুপ্রিম কোর্ট কোনও তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে, এমন নজির বিরল। দলের একাংশের তাই আশঙ্কা, সুপ্রিম কোর্টও যদি রাজ্যকে ভর্ৎসনা করে তা হলে আরও মুখ পুড়বে। এ সবে রাজনীতির অস্ত্রটাও ভোঁতা হয়ে যাবে না তো!
হুল নিয়ে হাইকোর্ট
নির্দেশ
• প্রাথমিক তদন্ত করবে সিবিআই
• ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ফুটেজ ও ফরেন্সিক রিপোর্ট নেবে তারা
• ৭২ ঘণ্টার মধ্যে প্রাথমিক তদন্ত শেষ করতে হবে
• তার ভিত্তিতে এফআইআর করে মূল তদন্ত করবে সিবিআই
• আইপিএস সৈয়দ মির্জাকে সাসপেন্ড করতে হবে
• ৭ দিনের মধ্যে মির্জার বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করুক রাজ্য
পর্যবেক্ষণ
ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি নিশীথা মাত্রে
• প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছে ভিডিও ফুটেজগুলি অবিকৃত
• এ ভাবে টাকা নেওয়া আদালতগ্রাহ্য অপরাধ
• অভিযুক্তরা সরকারি পদ ব্যবহার করেছেন, পদে রয়েছেন
• সেই কারণেই সিবিআইকে দিয়ে প্রাথমিক তদন্ত
• ম্যাথুর ভূমিকা যাই হোক, অভিযুক্তরা ছাড় পেতে পারে না
• অভিযুক্তরা প্রভাবশালী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব
• তাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গণতন্ত্রের পক্ষে ক্ষতিকর
• অভিযুক্তদের হাতে রাজ্য পুলিশ পুতুলের মতো নেচেছে
বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী
• জনপ্রতিনিধি ও নেতাদের সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকা উচিত
• এঁরা দুর্নীতিতে জড়ালে মানুষের বিশ্বাস টলে যায়
• সমাজে বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ে
এক বছরের টানাপড়েন
২০১৬
• ১৪ মার্চ: নারদ স্টিং অপারেশনের ভিডিও ফুটেজ প্রকাশ
• ১৬ মার্চ: ফুটেজের সত্যতা যাচাই ও নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে জনস্বার্থ মামলা
• ১৮ মার্চ: নারদ নিউজকে নোটিস পাঠাতে হাইকোর্টের নির্দেশ
• ২২ মার্চ: অভিযুক্তদের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় হাইকোর্টে বলেন, ঘুষ ও অনুদানের মধ্যে ফারাক আছে। ম্যাথুকে ফুটেজ জমা দেওয়ার নির্দেশ
• ৮ এপ্রিল: ফুটেজ কেন্দ্রীয় কোনও সংস্থার কাছে রাখা যায় কি না , তা ভেবে দেখা যেতে পারে, বলল হাইকোর্ট
• ১১ এপ্রিল: ফুটেজ হেফাজতে নিতে তিন সদস্যের কমিটি গড়ল হাইকোর্ট
• ২৯ এপ্রিল: হাইকোর্ট ফুটেজ যাচাইয়ের দায়িত্ব দিল হায়দরাবাদের ফরেন্সিক ল্যাবরেটরিকে
• ২৪ জুন: ফুটেজ খাঁটি কি না, বলতে পারল না হায়দরাবাদ। ফুটেজ গেল চণ্ডীগড়ে।
• ০৫ অগস্ট: কোর্টে এল ফুটেজের ফরেন্সিক রিপোর্ট। ডিভিশন বেঞ্চ অবশ্য তা প্রকাশ করল না।
• ০৯ অগস্ট: ফুটেজ যে বিকৃত নয় – তা বলল হাইকোর্ট।
• ১৬ সেপ্টেম্বর: টাকা নেওয়া অপরাধ কি না, তদন্তের নির্দেশ দেওয়ার আগে তার বিচার হবে জানাল হাইকোর্ট।
• ২২ নভেম্বর: ম্যাথু স্যামুলেয়ের উদ্দেশে লুক আউট নোটিস জারি কলকাতা পুলিশের।
• ২৫ নভেম্বর: ম্যাথু স্যামুয়েলকে তলব করল লালবাজার।
২০১৭
• ১৯ জানুয়ারি: স্টিং অপারেশন ভুয়ো নয়। সত্যতা প্রকাশ প্রয়োজন জানাল হাইকোর্ট।
• ২০ জানুয়ারি: নারদ তদন্ত তারা করতে পারবে কি না, সিবিআইয়ের কাছে তা জানতে চাইল হাইকোর্ট।
• ১৭ মার্চ: সিবিআই তদন্তের নির্দেশ কলকাতা হাইকোর্টের।