উৎসবের নামে চলল তাণ্ডব। ছবি: সৈকত দাস এবং এক্স।
সোমবার কালীপুজোর রাতে কলকাতা জুড়ে উৎসবের নামে কার্যত শব্দতাণ্ডব শোনা গেল। যার জেরে আতঙ্কিত বয়স্ক মানুষ থেকে পশু-পাখি। রাত পর্যন্ত পাড়ায় পাড়ায় নাগাড়ে ফেটেছে শব্দবাজি। উৎসবের দোহাই দিয়ে ট্রেন-মেট্রো লক্ষ্য করে অত্যুৎসাহীরা ছুড়লেন চকোলেট বোমা পর্যন্ত!
দীপাবলির রাতে মাস্টারদা সূর্য সেন মেট্রো স্টেশনের (বাঁশদ্রোণী এলাকা) সামনে চলতে থাকা শব্দবাজির তাণ্ডবে একটি পথকুকুর ভয় পেয়ে মেট্রোয় উঠে পড়েছিল (কী ভাবে সে নিরাপত্তার বলয় পেরিয়ে সোজা কামরায় ঢুকেছে, কারও জানা নেই)। মেট্রোর কামরার ভিতরে আতঙ্কে ছোটাছুটি শুরু করছিল সে। শহিদ ক্ষুদিরাম মেট্রো স্টেশনে (ব্রিজি এলাকা) মেট্রো থামার পর কুকুরটিকে নামানো হয়।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বাঁশদ্রোণী স্টেশন পেরোনোর পর হঠাৎ একটি পথকুকুর নজরে পড়ে তাঁদের। শহিদ ক্ষুদিরাম স্টেশনগামী মেট্রোর সামনের দিকের কোনও একটি কামরায় উঠে পড়েছিল সারমেয়টি। এক কামরা থেকে অন্য কামরায় ছোটাছুটি করছিল৷ চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। যাত্রীদের অনেকে আবার মেট্রোর মধ্যে ভয় পেয়ে যান। কেউ মশকরা করে বলেন, ‘‘টিকিট আছে তো এর!’’ আর এক যাত্রীর কটাক্ষ, ‘‘এই তো কলকাতা মেট্রোর নিরাপত্তার বহর।’’
কেউ কেউ কুকুরটিকে ধরার চেষ্টা করেও পারেনি। ক্ষুদিরাম মেট্রো স্টেশনে মেট্রো থামার পরে কুকুরটিকে নামানো হয়। খবর পেয়ে ছুটে এসেছিলেন মেট্রোর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা লোকজন।
শুধু মেট্রোই নয়, শব্দবাজির ‘দাপট’ দেখা এবং শোনা গিয়েছে লোকাল ট্রেনেও। যেমন বনগাঁ লাইনে ট্রেনের কামরা লক্ষ্য করে বেশ কয়েক জন চকোলেট বোমা ছুড়ে মারেন। স্বাভাবিক ভাবে আতঙ্ক ছড়ায় যাত্রীদের মধ্যে। কিন্তু চলমান যানে তাঁরা অসহায়। বিরক্ত হলেও করণীয় কিছুই নেই।
একই পরিস্থিতি দেখা গিয়েছে কলকাতার বিভিন্ন রাস্তায়। চলমান গাড়ি লক্ষ্য করে পটকা, বাজি ছুড়ে দীপাবলি ‘শুভ’ করেছেন অনেকে। এতে যে বড় বিপদ হতে পারে, সে সব যেন এই নাগরিকদের ভাবনাতেই নেই। কিছু জায়গায় পুলিশের টহলদারি দেখা গিয়েছে বটে, কিন্তু ‘খেলা’ হয়েছে পাড়ার ভিতরে। রাত দেড়টার পরেও পাটুলি, যাদবপুর ইত্যাদি এলাকায় শব্দবাজির দাপাদাপির ছাপ এবং প্রমাণ মিলেছে৷ বাড়িতে সমস্যায় পড়েন অসুস্থ, প্রবীণ মানুষেরা। বাইরে পথকুকুররা।
সোমবার রাতে শেষ মেট্রো এবং বনগাঁ শাখার কথা নির্দিষ্ট করে উল্লেখ করা হলেও আরও কিছু ঘটনার খবর মিলেছে। যেমন, দমদমের আগে ও পরে ট্রেনের কামরা লক্ষ্য করে শব্দবাজি ছুড়ে মারার একাধিক ঘটনা ঘটেছে। বেলগাছিয়া ও দমদম মেট্রো স্টেশনের মাঝামাঝি রাত সাড়ে ৯টা নাগাদ যাত্রীদের লক্ষ্য করে চকোলেট বোমা ছোড়ার অভিযোগ শোনা গিয়েছে। পূর্ব রেলের বনগাঁ শাখার দুর্গানগর ও বিরাটি স্টেশনের মাঝে চলন্ত ট্রেনের মধ্যে জোরালো আওয়াজের কিছু শব্দবাজি ছোড়ার খবর মিলেছে।
কলকাতা এবং কলকাতা পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে দীপাবলির রাতে ঘরে ও বাইরে, সর্বত্র লাগামছাড়া শব্দ এবং বায়ুদূষণ হয়েছে। শব্দবাজির তাণ্ডবে অস্থির এবং আতঙ্কিত গৃহস্থ। ভয়ে কাঁপছে পোষ্যেরা। এমনকি, পোষ্যের কানে যাতে জোরালো শব্দ প্রবেশ না করে সে জন্য বাড়ির মধ্যে রেখে তাদের কানে তুলো চাপা দিয়ে রাখেন কেউ কেউ।
রাত ১২ টার পর তাৎক্ষণিক হিসাব থেকে জানা যাচ্ছে, বালিগঞ্জ ও বিধাননগর এলাকায় দূষণের সর্বোচ্চ মাত্রা ৪০০-র গণ্ডি পেরিয়েছে। ‘দূষণ’ পরিস্থিতি এমন যে, দিল্লিকে টেক্কা দিয়েছে কলকাতা ও সল্টলেক। রাত ৮টা থেকে ১০টার পর্যন্ত সবুজ বাজি ছাড়া অন্য কোনও বাজি পোড়ানোতে নিষেধাজ্ঞা ছিল। বাজি পোড়ানোর সময় ছিল ১০টা পর্যন্তই। বড় জোর শব্দ হওয়া উচিত চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ ডেসিবেল। তবে প্রায় রাত ২টো বাজার পরেও দেখা গেল শব্দবাজির তাণ্ডব তখনও কমেনি। ‘উচিত’ মাত্রা ছাপিয়ে শব্দ তখন প্রায় দ্বিগুণ। সুপ্রিম কোর্ট ও পুলিশকে কার্যত বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলছে ‘উল্লাস’। আতঙ্কিত শিশু থেকে বৃদ্ধ, অসুস্থ মানুষেরা। শব্দ-দাপটে অনেকেই অসুস্থ বোধ করছেন। মানুষের পাশাপাশি ভীত পশু ও পাখিরাও। সকলকে আতঙ্কে রেখে ‘তাণ্ডবকারী’রা করছেন উৎসব উদ্যাপান। আর এতেই প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে পুলিশের ‘উপযুক্ত’ পদক্ষেপ’ নিয়ে। যদিও লালবাজার সূত্রে খবর, নিয়ম ভঙ্গের অভিযোগে রাত ৮টা পর্যন্ত ৪৫ জনকে গ্রেফতার ও ৫২২ কেজি বেআইনি বাজি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। প্রশ্ন উঠছে, ৮টার পর থেকে ‘বিকট’ শব্দের আওয়াজগুলি তবে কী ছিল?