গাইঘাটার আমকোলা। উত্তর ২৪ পরগনার এ তল্লাটে পঞ্চায়েতের বসানো নলকূপের জল খায় অন্তত দেড়শো পরিবার। যে নলকূপের প্রতি লিটার জলে আর্সেনিকের পরিমাণ ৯০.৩ মাইক্রোগ্রাম!
মানে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু) নির্ধারিত সহনমাত্রার ৯ গুণ!
জাতীয় পরিবেশ প্রযুক্তি গবেষণা সংস্থা (নিরি)-র এ হেন সমীক্ষা-রিপোর্ট দেখলে আঁতকে ওঠা ছাড়া উপায় নেই। যদিও পশ্চিমবঙ্গে বসে এ দিক থেকে ও-দিকে নজর ঘোরালেই এমন ছবি। যেমন উত্তর ২৪ পরগনারই তেঘরিয়ায় পোতা অঞ্চলে ঢুঁ মারলে দেখা যাবে, শিশুবিকাশ কেন্দ্র লাগোয়া পঞ্চায়েতের নলকূপটি থেকে বাসিন্দারা দেদার জল খাচ্ছেন। এ দিকে নিরি জানাচ্ছে, ওই জলের ফি লিটারে আর্সেনিক রয়েছে ৯৪.৬ মাইক্রোগ্রাম! হু নির্ধারিত সহনমাত্রার ৯ গুণের বেশি!
আমকোলা বা পোতা— কোনও নলকূপেই আর্সেনিক পরিশোধনের ব্যবস্থা নেই। এবং বিপদ সম্পর্কে মানুষকে অবহিত করারও বালাই রাখেনি প্রশাসন। তবে পরিশোধন যন্ত্র থাকলেও কাজের কাজ কতটা হতো, তা নিয়ে প্রভূত সংশয়। কারণ, কেন্দ্রীয় ভূ-জল পর্ষদের রিপোর্ট বলছে, তামাদি প্রযুক্তি ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বেশ কয়েকটি আর্সেনিক পরিশোধক অকেজো হয়ে গিয়েছে। সেখান থেকে আদতে বিষাক্ত জলই ঢুকছে মানুষের শরীরে।
এমতাবস্থায় সঙ্কটের ছায়া আরও গাঢ় হয়ে চেপে বসছে। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের ৯টি জেলার ৮৩টি ব্লকই আর্সেনিকের করাল গ্রাসে! পাশাপাশি আর একটি বিষয়ের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন পরিবেশবিদদের বড় অংশ। সেটা হল— আর্সেনিকের সহনমাত্রা। হু-র বিচারে, লিটারপিছু জলে ১০ মাইক্রোগ্রামের বেশি আর্সেনিক থাকলেই বিপদ। অথচ পশ্চিমবঙ্গ সরকার তা ৫০ মাইক্রোগ্রামে বেঁধে দিয়েছে, যা কিনা আর্সেনিক-প্রবণ নয় এমন এলাকার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে বলে হু-র দাবি। অভিযোগ, সহনমাত্রা বাড়িয়ে রাখায় বহু অঞ্চল আর্সেনিক-দূষিত হয়েও বিপদ-তালিকায় ঠাঁই পাচ্ছে না। ফলে মানুষ নিশ্চিন্তে দূষিত জল খেয়ে যাচ্ছেন।
এবং এতে ভবিষ্যতে গুরুতর স্বাস্থ্য-সমস্যার আশঙ্কায় রয়েছেন পরিবেশবিদ ও ডাক্তারদের কেউ কেউ। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞানের অধ্যাপক তথা জনস্বাস্থ্য-বিজ্ঞানী দীপঙ্কর চক্রবর্তীর পর্যবেক্ষণ, ‘‘লিটারে ৫০ মাইক্রোগ্রাম আর্সেনিক রয়েছে, এমন জল টানা এক বছর খেলে হাজার জনের মধ্যে ১৩ জন ক্যানসারে আক্রান্ত হতে পারেন। এটা সহনমাত্রা হতে পারে না।’’ যদিও রাজ্য সরকার তা মানতে নারাজ। বিশদ ব্যাখ্যায় না-গিয়ে রাজ্য জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের (পিএইচই) এক কর্তার মন্তব্য, ‘‘আমরা মনে করি, পশ্চিমবঙ্গে এটাই আর্সেনিকের সহনমাত্রা হওয়া উচিত।’’
গাইঘাটা-তেঘরিয়ার প্রাথমিক সমীক্ষা-রিপোর্ট কি বড় বিপর্যয়ের ইঙ্গিতবাহী?
নিরি-র বিজ্ঞানী দীপাঞ্জন মজুমদারের জবাব, ‘‘প্রাথমিক রিপোর্ট দেখে বিশদ অনুমান করা ঠিক হবে না। কারণ, একই জায়গায় নলকূপের গভীরতাভেদে আর্সেনিকের মাত্রা কম-বেশি হতে পারে।’’ ভূ-জল কর্তারা মনে করেন, প্রতিরোধের বর্তমান ব্যবস্থা কতটা কার্যকরী, সেটা যাচাই করা সবচেয়ে জরুরি। দেখতে হবে, পরিশোধন যন্ত্রগুলো ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা। শুনে রাজ্যের আর্সেনিক টাস্ক ফোর্সের চেয়ারম্যান কুমারজ্যোতি নাথের আশ্বাস, ‘‘পিএইচই-কে বলা হয়েছে, পরিশোধন যন্ত্রগুলো যেন বাইরের কোনও কোম্পানিকে দিয়ে পরীক্ষা করানো হয়। যে সব নলকূপের জলে মাত্রাধিক আর্সেনিক, সেগুলো লাল রং করে দিতে হবে। ওখানে পরিস্রুত জল সরবরাহেও জোর দেওয়া হচ্ছে।’’
পরিবেশবিদেরা তা-ও নিশ্চিন্ত হতে পারছেন না। তাঁদের মতে, পরিশোধন যন্ত্রের মান সম্পর্কে প্রশ্ন উঠলে নলকূপ বন্ধই করে দিতে হবে। গেরস্থালি বা সেচের কাজেও তার জল ব্যবহার করা উচিত নয়। বিশেষজ্ঞেরা জানাচ্ছেন, বিপজ্জনক মাত্রার আর্সেনিকযুক্ত জল দিয়ে রান্না হলে বিষ সরাসরি শরীরে ঢোকে। আবার সেচের কাজে লাগালে ধান, খড় বা আনাজপাতি মারফত আর্সেনিক ঢুকে পড়ে খাদ্যশৃঙ্খলে। এতে বাইরের এলাকার লোকজনও এই মারণ দূষণের কবলে পড়তে পারেন। সরকার কী বলে?
রাজ্যের জনস্বাস্থ্য-কারিগরিমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের দাবি, তাঁরা যথাসাধ্য করছেন। ‘‘আগের সরকার তো কিছুই করেনি। আমরা গত চার বছরে চেষ্টা করেছি। আন্তর্জাতিক সাহায্য পেয়েছি। নদিয়া জেলা আর্সেনিকমুক্ত ঘোষিত হয়েছে। অন্যত্র জোরকদমে কাজ চলছে।’’— বলেন সুব্রতবাবু। তিনি জানিয়েছেন, ২০২০-র মধ্যে আর্সেনিক দূরীকরণের লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে। নদীর জল শোধন করে মাথাপিছু ৭০ লিটার পানীয় জল বরাদ্দের পরিকল্পনাও রয়েছে।
পরিকল্পনা কবে বাস্তবায়িত হয়, আপাতত তারই প্রতীক্ষা।