দেওয়াল জুড়ে নোটবাতিল, ‘অচ্ছে দিন’-এর প্রতিশ্রুতিকে কটাক্ষ ঘাসফুলের। খানিক দূরেই সারদা, নারদ-কাণ্ড নিয়ে কার্টুনে জবাব পদ্মের। এক সময়ে লড়াইটা যেখানে সীমাবদ্ধ ছিল বাম-কংগ্রেসের মধ্যে, সেই কাটোয়ায় এখন ফুলও ফুটছে। কয়েক বছর আগেও কংগ্রেসের ঘাঁটি বলে পরিচিত এলাকায় এ বার জমে উঠেছে চতুর্মুখী লড়াই।
বাম আমলেও কাটোয়া বিধানসভা এলাকা ছিল কংগ্রেসের ‘শক্ত জমি’। দু’দশকেরও বেশি সময়ের সেই আধিপত্যে দাঁড়ি পড়েছে ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে। প্রথম বার জয়ী হয় তৃণমূল। তার আগের বছর অবশ্য কাটোয়া পুরসভা দখলে নেয় তারা। তৃণমূল কর্মীদের একাংশের অবশ্য দাবি, কংগ্রেসের হাত থেকে কাটোয়ার ক্ষমতা ছিনিয়ে নিলেও এলাকায় দল যে খুব স্বস্তিতে আছে, তা নয়। তার অন্যতম কারণ, দলের অন্দরে ‘দ্বন্দ্ব’। এলাকায় সিপিএমেরও ভাল সংগঠন রয়েছে। সেই সঙ্গে এ বার নানা জায়গায় উড়তে দেখা যাচ্ছে বিজেপির পতাকাও।
২০১৫ সালের পুরভোটের পরে এলাকার দীর্ঘদিনের কংগ্রেস বিধায়ক রবিরঞ্জন চট্টোপাধ্যায় যোগ দেন তৃণমূলে। পরের বছর বিধানসভা ভোটে তাঁকে প্রার্থী করে তৃণমূল। কংগ্রেস প্রার্থী শ্যামা মজুমদারের সঙ্গে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরে ৯১১ ভোটে জেতেন তিনি। কাটোয়া শহরে প্রায় সাড়ে চারা হাজার ভোটে পিছিয়ে পড়েছিলেন রবিবাবু। তাঁর ‘লিড’ ছিল মাত্র ৫টি ওয়ার্ডে। কাটোয়া ২ ব্লকের ছ’টি পঞ্চায়েত ও দাঁইহাট পুরসভা এলাকার ভোটের জোরে বিধায়ক পদ ধরে রাখতে সক্ষম হন তিনি। ২০১৭ সালে পুরপ্রধান অমর রামের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা হয়। অমরবাবুকে সরিয়ে পুরপ্রধান হন রবিবাবু।
তৃণমূল সূত্রের খবর, এর পর থেকেই এলাকায় দলের নেতৃত্বের রাশ গিয়েছে রবিবাবুর হাতে। ক্রমশ ‘নিষ্ক্রিয়’ হয়েছেন অমরবাবু। এর মধ্যে অনাস্থা এনে সিপিএমের হাতে থাকা দাঁইহাট পুরসভাও দখল করেছে তৃণমূল। গত বছর সব পঞ্চায়েতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হয়েছে শাসকদল। রবিবাবুর দাবি, এ বার কাটোয়া থেকে দলের প্রার্থী ২০ হাজার ভোটে ‘লিড’ পাবেন।
গত লোকসভা নির্বাচনে প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে এই এলাকায় তিন নম্বরে ছিল কংগ্রেস। তবে বর্ধমান পূর্ব কেন্দ্রে দল যে ৬৯ হাজারের কাছাকাছি ভোট পেয়েছিল, তার প্রায় ৪১ হাজারই কাটোয়া থেকে। দলের নেতাদের দাবি, রবিবাবুর দলবদলের প্রভাব সংগঠনে পড়লেও তা এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছেন তাঁরা। বুথ ধরে-ধরে ৪-৫ জনের দল তৈরি করা হয়েছে। সেই দলে থাকছেন এক জন আহ্বায়ক। সিঙ্গি, শ্রীবাটি, গাজিপুরে নিয়মিত বৈঠক করা হচ্ছে। কাটোয়া মহকুমা কংগ্রেসের সভাপতি জগদীশ দত্তের কথায়, ‘‘গত বিধানসভা ভোটে কাটোয়ার মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কংগ্রেসের সঙ্গে আছেন।’’ তবে তৃণমূলের ভয়ে অনেকেই তাঁদের মিটিং-মিছিলে যোগ দিতে পারছেন না বলে অভিযোগ তাঁর।
২০১৪ সালে চারমুখী লড়াইয়ে প্রায় ৩২ শতাংশ ভোট পেয়ে কাটোয়ায় ‘লিড’ নিয়েছিল সিপিএম। দু’বছর পরে কংগ্রেসের সঙ্গে আসন সমঝোতায় এখানে কোনও প্রার্থী দেয়নি বামেরা। তবে সংগঠন এখন বেশ শক্ত রয়েছে বলে দাবি সিপিএম নেতাদের। তাঁরা জানান, সুদপুর, গোয়াই, জগদানন্দপুর, দাঁইহাটের নানা এলাকায় সংগঠনের জোর রয়েছে। গোটা এলাকায় দু’হাজারের বেশি দেওয়াল লিখন করেছে তারা। এ বার বড় মিছিলের বদলে বাড়ি-বাড়ি গিয়ে ও সোশাল মিডিয়া মারফত জনসংযোগে জোর দিয়েছে সিপিএম। দলের প্রার্থী ঈশ্বরচন্দ্র দাসের বক্তব্য, ‘‘বিধায়কের দলবদল অবশ্যই এখনও এখানকার ভোটে অন্যতম ‘ফ্যাক্টর’। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে না ওঠা, ভাগীরথীর ভাঙনের মতো বিষয়গুলি প্রচারে তুলে ধরছি।’’
বছর তিনেক আগেও বিধানসভা এলাকায় গোটা দুয়েক বড় কার্যালয় ছিল বিজেপির। ২০১৪ সালে এলাকায় প্রায় ১৬ শতাংশ ভোট পেলেও দু’বছর পরে তা কমে দাঁড়ায় সাতে। কিন্তু সম্প্রতি কাটোয়ার নানা এলাকায় টের পাওয়া যাচ্ছে গেরুয়া শিবিরের উপস্থিতি। বিজেপি সূত্রের দাবি, বিধানসভা অঞ্চলের মোট ২৯৭টি বুথের মধ্যে ২৭৫টিতে বুথ কমিটি গঠন করা হয়েছে। ২১২টি বুথের প্রায় বারোশো দেওয়াল লিখন হয়েছে। আগে দাঁইহাটে জেলা কার্যালয় ও কাটোয়ায় একটি কার্যালয় ছিল। এখন বিধানসভা কেন্দ্রে রয়েছে দলের মোট ছ’টি কার্যালয়। নেতাদের দাবি, অগ্রদ্বীপ, করুই, ওকড়শা, খাজুরডিহি, গাজিপুরে শক্তিবৃদ্ধি হয়েছে দলের। বিজেপির নানা মিছিলে ভিড়ও নজরে পড়ছে। পরপর দু’বছর রামনবমীর মিছিলে ভাল জমায়েত দেখা গিয়েছে কাটোয়া শহরে। এলাকার বিজেপি নেতা অনিল দত্ত দাবি করেন, ‘‘শহরে পরিকল্পনাহীন ফুটপাত, রেলগেটে উড়ালপুল তৈরিতে শাসকদলের ব্যর্থতা, তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বের জেরে পুরসভার কর্মী ছাঁটাই, দুর্নীতি নিয়ে সরব হচ্ছি। ভাল সাড়া পাচ্ছি। এ বার এখান থেকে কুড়ি হাজার ভোটে ‘লিড’ পাব আমরা।’’
স্থানীয় বাসিন্দাদের ক্ষোভ, উড়ালপুল না হওয়ায় রেলগেটেই দিনের অনেকটা সময় কেটে যায় শহরের যাত্রীদের। ভাগীরথীর ভাঙন রোধে দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থা হয়নি। তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র তৈরির কাজ থমকে রয়েছে। ‘লিড’ যে দলই পাক না কেন, এ সব সমস্যার হাল কতটা হবে, সংশয় কাটছে না তাঁদের।