মানাচরে জঙ্গল সাফের নালিশ, ‘উদাসীন’ বন দফতর

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তাঁদের বাস নদীর চরে। তাই দামোদরের ভাঙন থেকে ওই জঙ্গলই তাঁদের রক্ষা করে। কিন্তু, যে ভাবে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, অবিলম্বে তা বন্ধ না করা গেলে একটিও গাছ বাঁচবে না। বন্যা হলে নদীর জল উঠে আসবে গ্রামে।”

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিপ্লব ভট্টাচার্য

বাঁকুড়া ও কাঁকসা শেষ আপডেট: ২১ নভেম্বর ২০১৮ ০১:৩৯
Share:

এক সময়ের জঙ্গল এখন সাফ, অভিযোগ এলাকায়। নিজস্ব চিত্র

প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে ধাপে ধাপে কয়েক হাজার বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হয়েছিল জঙ্গল। এর ফলে এক দিকে যেমন বনসৃজন হয়েছিল, তেমনই নদী ভাঙনের হাত থেকেও রক্ষা পাচ্ছিলেন দামোদর নদের মানাচরের কয়েকটি গ্রাম। অথচ নজরদারির অভাবে গত কয়েক বছরে সেই জঙ্গলের অনেকখানি সাফ করে চাষবাস শুরু হয়ে গিয়েছে। কাঁকসা লাগোয়া বড়জোড়া থানার বাবনাবেড়া, বিহাপুর ও মোবারকগঞ্জ এলাকার জঙ্গলের এমনই অবস্থা বলে অভিযোগ তুলে বন দফতরকে বিঁধছেন স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশ।

Advertisement

ওই গ্রামগুলি কাঁকসা থানার মধ্যে পড়লেও জঙ্গলটি বাঁকুড়া উত্তর বন বিভাগের বড়জোড়া রেঞ্জের আওতাধীন। ওই এলাকা বড়জোড়া ব্লকের মধ্যেও পড়ে। জঙ্গল ধংসের জন্য বাসিন্দারা বন দফতরের বিরুদ্ধে উদাসীনতার অভিযোগ তুললেও বন দফতর ওই এলাকায় জমি জট রয়েছে জানিয়ে দায় চাপাচ্ছে প্রশাসনের উপর। বনদফতর ও প্রশাসনের এই টানাপড়েন বজায় থাকলে ওই এলাকার জঙ্গলের অস্তিত্ব আদৌ থাকবে কি না, তা নিয়েই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে বিভিন্ন মহলে।

বন দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, আশির দশকে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি) গঙ্গাজলঘাটির দুর্লভপুরে মেজিয়া তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র গড়ে তোলে। সে জন্য ওই এলাকার বনভূমির কিছু অংশ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আওতায় চলে যায়। এ ক্ষেত্রে অধিগৃহীত বনভূমির সমপরিমাণ জমিতে বন করে দেওয়ার কথা। সে জন্য দামোদরের তীরে বাবানবেড়া, বিহারপুর, মোবারকগঞ্জ সংলগ্ন এলাকার সরকারি খাস জমিতে বনসৃজন কর্মসূচি নেওয়া হয়।

Advertisement

বনসৃজনের মাধ্যমে ওই গ্রামাঞ্চলে দামোদরের ভাঙন রোধ করাও লক্ষ ছিল প্রশাসনের। বন দফতর ওই এলাকায় জঙ্গল তৈরির কাজ শুরু করে। ২০১৬ সাল পর্যন্ত গাছ লাগানোর পর্ব চলে প্রায় তিন হাজার বিঘা জমিতে। ১৯৯৪ সালে বন সুরক্ষা কমিটিও গড়া হয় স্থানীয় লোকজনদের নিয়ে। জঙ্গল দেখাশোনা করার জন্য বন দফতর ঘরও তৈরি করে দেয় জঙ্গল এলাকায়। বাসিন্দাদের দাবি, বর্তমানে বন সুরক্ষা কমিটির কোনও অস্তিত্ব নেই। বন দফতরও জঙ্গল রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছে বলে দাবি।

মোবারকগঞ্জ এলাকার বাসিন্দা পিনাকীরঞ্জন দাস, সঞ্জীব মণ্ডল, সুশান্ত ধাড়ার অভিযোগ, ‘‘বন দফতরের নজরদারি সরতেই রাতের অন্ধকারে একের পর এক গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। গাছহীন জঙ্গলে জমিতে চাষাবাদ শুরু করেছেন কিছু মানুষ।’’ এ সব বন্ধ করতে বন দফতরের দ্বারস্থ হন বাসিন্দারা। একাধিকবার বন দফতরে লিখিত ভাবে জঙ্গল রক্ষার দাবি তুলেছেন তাঁরা। অথচ বন দফতর সাড়া দেয়নি বলে তাঁদের দাবি।

স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, তাঁদের বাস নদীর চরে। তাই দামোদরের ভাঙন থেকে ওই জঙ্গলই তাঁদের রক্ষা করে। কিন্তু, যে ভাবে গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে, অবিলম্বে তা বন্ধ না করা গেলে একটিও গাছ বাঁচবে না। বন্যা হলে নদীর জল উঠে আসবে গ্রামে।”

কেন এমন হল?

কাঁকসার ব্লক ভূমি ও ভূমি সংস্কার আধিকারিক দেবদাস গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ওই জঙ্গলভূমি বাঁকুড়া জেলা প্রশাসনের আওয়ায়। তাই এখান থেকে কিছু করার নেই।’’ বন দফতরের অভিযোগ, ওই এলাকায় বনসৃজন করে জায়গাটি প্রশাসন বন দফতরকে হস্তান্তর করবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। কিন্তু এখনও পর্যন্ত জায়গাটি বন দফতরের নামে হস্তান্তর হয়নি। তাই ২০১৬ সাল থেকে জঙ্গল দেখাশোনার কাজ বন্ধ করে দেয় বড়জোড়া রেঞ্জ। বড়জোড়ার রেঞ্জ অফিসার বিশ্বজিৎ মাল বলেন, “প্রশাসন জমিটি বন দফতরের নামে হস্তান্তর না করায় সেখানে বনভূমি আইন প্রয়োগ করতে পারছি না আমরা। জঙ্গল-চুরি রুখতে গিয়ে উল্টে নানা আইনগত সমস্যার মধ্যে আমাদেরই পড়তে হচ্ছে। তাই বাধ্য হয়ে সরে আসতে হয়েছে।”

ডিএফও (বাঁকুড়া উত্তর) ভাস্কর জেভি বলেন, “সমস্যাটি রাজ্য স্তরে জানানো হয়েছে। রাজ্য থেকে আমাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠক করে সমস্যা মেটাতে। আমরা শীঘ্রই জেলার সঙ্গে এ নিয়ে আলোচনায় বসব।” বাঁকুড়ার অতিরিক্ত জেলাশাসক (ভূমি ও ভূমি সংস্কার) সব্যসাচী সরকার বলেন, “গোটা ঘটনাটি আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি। ওই এলাকার জমি কার নামে রেকর্ড রয়েছে, বন দফতরের সঙ্গে প্রশাসনের কোনও চুক্তি হয়েছিল কি না, এই সব খতিয়ে দেখে পদক্ষেপ করব।”

প্রশাসনিক এই জটিলতা কাটতে কত দিন সময় লাগবে তার সদুত্তর নেই। তত দিন কি জঙ্গল বাঁচানো যাবে, চিন্তায় দামোদর লাগোয়া গ্রামের বহু বাসিন্দা।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন