দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন। —ফাইল চিত্র।
দক্ষিণবঙ্গে জেলাগুলিতে বন্যা পরিস্থিতির জন্য দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন (ডিভিসি)-কে দায়ী করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তথা তাঁর দল তৃণমূল। মঙ্গলবার দলনেত্রীর নির্দেশে মাইথনে ডিভিসি-র মুখ্য কার্যালয়ে গিয়ে ডেপুটেশন জমা দিলেন মন্ত্রী মলয় ঘটকেরা। মলয়ের নেতৃত্বে তৃণমূল নেতৃত্ব ডিভিসি-র আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকও করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে রাজ্যের আইন ও বিচারমন্ত্রী মলয়ের ঘোষণা, ‘‘ডিভিসি যে ড্রেজ়িং করেনি, সেটা তারা মেনে নিয়েছে।’’ তাঁর আরও দাবি, এ বার থেকে ডিভিসি-র ছাড়া জলে কেউ মারা গেলে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রীয় সংস্থাকেই। ওই বৈঠকের পর ডিভিসি পাল্টা দাবি করেছে, ড্রেজ়িং নিয়ে রূপরেখা তৈরি হচ্ছে। সেটা দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। তবে রাজ্যকে না-জানিয়ে ডিভিসি-র জল ছাড়ার অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন সংস্থার এগ্জ়িকিউটিভ ডিরেক্টর সুমনপ্রসাদ সিংহ।
মলয়ের নেতৃত্বে ঝাড়খণ্ডের মাইথনে ডিভিসি-র মুখ্য কার্যালয়ে অবস্থান বিক্ষোভ করেছিল তৃণমূল। মঙ্গলবার সকাল ১১টা থেকে এই বিক্ষোভ সমাবেশে ছিলেন পশ্চিম বর্ধমান জেলার তৃণমূল সভাপতি তথা বিধায়ক নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। দুপুরে ডিভিসি-র আধিকারিকদের সঙ্গে বৈঠকের পর মলয় বলেন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা প্রমাণিত। বাংলায় ‘ম্যান মেড’ বন্যা হচ্ছে। বারংবার পশ্চিমবঙ্গকে না জানিয়ে জল ছেড়েছে ডিভিসি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘যখন ডিভিসি ছিল না, তখন দামোদরকে বলা হত ‘বাংলার দুঃখ।’ সেই দুঃখমোচনের জন্য ১৯৫৫ সালে দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশনের প্রতিষ্ঠা হল। কিন্তু তার পর দীর্ঘ ৩০-৪০ বছর ড্রেজ়িং হয়নি। ড্রেজ়িংয়ের বিষয়টি স্বীকারও করে নিয়েছেন সুমনপ্রসাদ।’’
মন্ত্রী তথা তৃণমূলের ওই প্রতিনিধিদলের দাবি, বিহার-ঝাড়খণ্ডে ভারী বৃষ্টি হলেই ভাসছে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশ। এর মূলে রয়েছে ডিভিসি। কর্তৃপক্ষ আগে থেকে আলোচনা না করেই জল ছাড়েন। মন্ত্রী জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী বরাবর দুর্গতদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সাহায্য করেছেন। ক্ষতিপূরণ দিয়েছেন। চাষিদের বিমা করিয়ে দিয়েছেন। এ বার ডেপুটেশনে তাঁদের দাবি, ডিভিসি-র ছাড়া জলে কোনও ক্ষতি হলে সেই ক্ষতিপূরণ ডিভিসি-কেই দিতে হবে। ডিভিসি-র ছাড়া জলে যদি কোনও প্রাণ যায়, অথবা কেউ মারা যাওয়ার মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়, ফৌজদারি আইন অনুযায়ী সেই দায় বর্তাবে তাদের উপরে। মন্ত্রীর কথায়, ‘‘এটা ডিভিসি-কে জানতে হবে।’’ তিনি এ-ও জানান, পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে না-জানিয়ে যদি ডিভিসি জল ছাড়ে, তা হলে আবার ডেপুটেশন দেবেন তাঁরা। ওই ডেপুটেশন গ্রহণ করেছেন সুমনপ্রসাদ। এ বার মুখ্যমন্ত্রীকে রিপোর্ট দেবেন। তার পর মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশমতো পদক্ষেপ করবেন। প্রয়োজনে ঘেরাও কর্মসূচি পালন করবেন। মন্ত্রী দাবি করেছেন, ডিভিসি-র এগ্জ়িকিউটিভ ডিরেক্টর স্বীকার করে নিয়েছেন যে, ড্রেজ়িং হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘তাই বিহার-ঝাড়খণ্ডে বৃষ্টি হলেই জল জমছে বাংলায়। ডিভিসি-র ছাড়া জলে দক্ষিণবঙ্গের বিস্তীর্ণ অংশ বছরে একাধিক বার বন্যার কবলে পড়ছে।’’
মলয়ের দাবি প্রসঙ্গে ডিভিসি-র এগ্জ়িকিউটিভ ডিরেক্টরের অবশ্য দাবি, রাজ্যকে না-জানিয়ে জল তাঁরা ছাড়েন না। তিনি বলেন, ‘‘ডিভিসি ‘সেন্ট্রাল ওয়াটার কমিশন’-এর পরামর্শে ছাড়ে। ডিভিআরএস-এর সদস্যেরা থাকেন কমিটিতে। পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড সরকারের প্রতিনিধিরা থাকেন সেখানে। জল ছাড়ার আগে সকলকে জানানো হয়। একটি হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপ আছে। তাতে পশ্চিমবঙ্গের অতিরিক্ত মুখ্যসচিব থাকেন। সেচ দফতরের আধিকারিক থাকেন। ঝাড়খণ্ড সরকারের প্রতিনিধিরা থাকেন। ডিভিসি-র প্রতিনিধিরা থাকেন। সকলেই জানতে পারেন, কত জল ছাড়া হবে। যত পরিমাণ জল ছাড়ার কথা ঠিক হয়, ততটাই জল ছাড়া হয়।’’ তাঁর সংযোজন, ‘‘এ বার কোনও কোনও দিন ৭২-৭৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়নি। এপ্রিলে বৈঠকে রাজ্য সরকারের মুখ্যসচিব ছিলেন। তাতে বলা হয়, লোয়ার ভ্যালির চ্যানেলে ক্যারিং ক্যাপাসিটি (জলধারণ ক্ষমতা) ১ লক্ষ ৩০ হাজার কিউসেক। কেন্দ্রের পরামর্শ মেনে জল ছাড়ার পরিমাণ কখনও ৭০ হাজার কিউসেকের উপরে হয়নি। আবার বলছি, জল ছাড়া হয় পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী। নিয়মিত ভাবে। প্রোটোকল আছে ২৩ হাজার কিউসিকের বেশি জল ছাড়তে হলে ৬ ঘণ্টা আগে জানানোর। সেটা ইমেল, টেলিফোনে, হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপে জানানো যায়।’’
অন্য দিকে, ডিভিসি এবং রাজ্যের এই দ্বৈরথের মধ্যে মঙ্গলবার জল ছাড়ার পরিমাণ অনেকটাই কমিয়েছে কেন্দ্রীয় সংস্থা। মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে ৩৫ হাজার কিউসেক জল ছাড়া শুরু করে তারা। মাইথন জলাধার থেকে ১২ হাজার কিউসেক এবং পাঞ্চেত থেকে ২৩ হাজার কিউসেক জল ছাড়া হয়েছে। তবে তৃণমূলনেত্রীর নির্দেশে মঙ্গলবারই তৃণমূলের বিক্ষোভ এবং অভিযোগ নিয়ে ডিভিসি জানিয়েছে, বাঁধ ড্রেজ়িং-এর জন্য কেন্দ্রের তরফে পলিসি তৈরি হচ্ছে। একটি পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। কিন্তু ড্রেজ়িং না-করার জন্য বন্যা হয়নি। সুমনপ্রসাদের সংযোজন, ‘‘ক্যারিং ক্যাপাসিটির অর্ধেক জল ছাড়া হয়। আর মুখ্যমন্ত্রী সাংবিধানিক পদে আসীন। তাঁর অভিযোগ নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেওয়ার জন্য উপযুক্ত ব্যক্তি নই আমি।’’