শহর জুড়ে ব্যস্ততা।
কেউ রাতের ঘুম ভুলে মূর্তি গড়ছেন, কেউ সব্জি, ফলের জোগান দিচ্ছেন, কেউ আবার পুজোর উপকরণ জোগাড়ে দিশেহারা। সরস্বতী পুজোর আগে ছোট-বড় ক্লাবের এই ব্যস্ততায় রোজকার চেনা ধীরে চলা কালনা যেন অনেকটাই অচেনা।
সরস্বতী পুজোর রমরমা অবশ্য কালনায় নতুন নয়। প্রতি বছরই প্রায় হাজার খানেক ক্লাব পুজোয় যোগ দেয়। মাস দেড়েক আগে থেকেই শুরু হয়ে যায় প্রস্তুতি। বড় ক্লাবেরা ভিন জেলা থেকে কারিগর আনেন, ছোট ক্লাবেরাও ভাবনার বৈচিত্র্যে নজর কাড়েন। নানা পুজোর উদ্বোধনে হাজির হন টলিউডের তারকারাও। আজ, শুক্রবারই বেশ কয়েকটা ক্লাব মণ্ডপের উদ্বোধন করে ফেলছে বলে জানা গিয়েছে। তার আগে ঢুঁ মেরে নেওয়া হল তাদের অন্দরে।
ভাগীরথীর গা ঘেঁষা পাথুরিয়া মহলের লায়ন ক্লাবের থিম ৫০ লম্বা ফুট শিব মন্দির। মণ্ডপের মাঝে থাকবেন রুপোর তৈরি প্রায় দেড় কেজি ওজনের সরস্বতী। দর্শক টানার জন্য মণ্ডপের পাশে রঙিন ফোয়ারাও থাকছে। শ্যামরায় পাড়ার সূর্য সমিতির থিম- কল্কি আসছে। শহরের এক শিল্পী সাধন দেবনাথ মণ্ডপ সাজানোর কাজ করছেন। ফাইবার নেট, রঙিন কাগজ, ফোম দিয়ে মণ্ডপে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে নানা দৃশ্য। চমক রয়েছে চার হাতের প্রতিমাতেও। বস্তা ও কাঠের গুঁড়ো দিয়ে সেজে উঠছে শ্যামগঞ্জ স্পোর্টিং ক্লাবের পিরামিড আদলের মণ্ডপ। ভেতর রাখা হচ্ছে বাক্সবন্দি মমি। আগের বার সন্দেশের প্রতিমা গড়ে এলাকায় হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিল লিচুতলার সমাপ্তি সঙ্ঘ। এ বার সীতাভোগ ও মিহিদানার প্রতিমা তৈরি করছে ওই ক্লাব। এছাড়া পুজোর দিনগুলিতে ১৬টি জীবন্ত মডেলের মাধ্যমে কিরণমালার দৃশ্য তুলে ধরছে তারা। পোড়া ইট কেটে তৈরি হয়েছে শ্যামগঞ্জ পাড়ার জলেশ্বর ক্লাবের প্রতিমা। স্কুল ছাত্রদের গড়া ওই মণ্ডপে মিলবে পাহাড়ের নানা দৃশ্য। রকমারি মডেলে সেজেছে ছোট দেউরি বাজারের ফ্রেন্ডস ক্লাবের মণ্ডপও। উদ্যোক্তারা জানান, নজর কাড়বে পেখম মেলা একটি ময়ূরের মডেল। দেড় মাস ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমে আমলাপুকুর ইয়ং বয়েজ ক্লাবের মণ্ডপ গড়েছেন নদিয়া জেলার ভীমপুরের শিল্পীরা। আজ, শুক্রবার সন্ধ্যায় উদ্বোধন হতে চলেছে অজন্তা, ইলোরা থিমের ওই মণ্ডপের। চাটাই, চট, প্ল্যাস্টার অফ প্যারিস-সহ নানা উপকরন দিয়ে শিল্পীরা ওই মণ্ডপে ফুটিয়ে তুলেছেন অসংখ্য গুহা চিত্র।
পুজো কমিটির সম্পাদক কৌশিক দে-র দাবি, মণ্ডপে ঢুকলে দর্শকরা নতুন এনেক কিছু জানতে পারবেন। কালীনগর পাড়ার ক্লাব ওয়ান্টেড বয়েজে গেলে আবার দেখা যাবে পুষ্পবৃষ্টি। রাশি রাশি ফুলে ওই মণ্ডপ গড়েছেন মেমারির চোতখণ্ডের শিল্পীরা। তামাক বর্জনকে মণ্ডপের থিম করেছে অধিকারী পাড়ার রোহিনী তারা ক্লাব। সিগারেট দিয়ে তৈরি হয়েছে এখানকার প্রতিমা। খড়ের তৈরি মণ্ডপে থাকছে হুঁকো, কল্কের মতো বেশ কিছু নেশার সরঞ্জামও। আদিবাসীদের যে একটা স্বতন্ত্র জগৎ রয়েছে তা টের পাওয়া যাবে চারবাগান এলাকার সবুজ সমিতির মণ্ডপে। রাজস্থানের একটি আদিবাসী মন্দিরের আদলে তৈরি এ মণ্ডপের প্রতিমা গড়া হয়েছে শিতলপাটি, কাঠ ইত্যাদি দিয়ে। চটের মণ্ডপে সূক্ষ কারুকাজ তুলে ধরেছে ১০৮ শিব মন্দির লাগোয়া স্পুটনিক ৭০ ক্লাব। উদ্যোক্তাদের দাবি, তাদের আসল তাস প্রতিমা। এলাকা জুড়ে আলো সাজিয়েছে বলাকা ক্লাব। উদ্যোক্তাদের দাবি, দর্শকেরা যখন শহরের রাশি রাশি ক্লাবের মণ্ডপ দেখে ক্লান্ত হয়ে পড়বেন তখন বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে হরেক রকমের আলো তাদের মুখে হাসি ফোটাবে। জাপটের অগ্নিবীণা ক্লাবের মণ্ডপে উঠে এসেছে ব্যাঙ্ককের বৌদ্ধ মন্দির। ওই এলাকার যুগের দ্বীপ ক্লাবের মণ্ডপও নজর কাড়ার মতো। মণ্ডপ তৈরির এক শিল্পী অভিজিৎ ঘটকের কথায়, প্রাশ্চাত্য সংস্কৃতিকে অন্ধ ভাবে অনুকরণ করতে গিয়ে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই সনাতন ধর্মের প্রাচীন ঐতিহ্যের কথা ভুলতে বসেছেন। মণ্ডপ তা মনে করিয়ে দেবে। পুরাতন বাসস্ট্যান্ড লাগোয়া ভাই ভাই সঙ্ঘ পুকুরের মধ্যে পদ্মের আকারে মণ্ডপ গড়েছে। এ ছাড়া শহরের শীতলা সঙ্ঘ, শিবসঙ্ঘ, বারুইপাড়া বারোয়ারি, ক্লাব অফ ইউনাইটেডের মতো বেশ কিছু মণ্ডপ রয়েছে যা চোখ টানবে দর্শকদের।
আলো, সাজের বাহারের পাশাপাশি শহরের অলি-গলিতেও মণ্ডপ গড়েছে হাজারো ক্লাব। আসতে শুরু করেছে একাধিক বাংলা ব্যান্ডের লোকজনও। উৎসবের মোড়কে, শিল্পীদের ছোঁয়ায়, আত্মীয়-পরিজনদের ভিড়ে চেনা শহর সেজেছে নতুন রূপে।
মূর্তি গড়া থেকে মণ্ডপ তৈরি, জোরকদমে চলছে সরস্বতী পুজোর প্রস্তুতি।
কাটোয়ায় ও ডান দিকে কালনায় অসিত বন্দ্যোপাধ্যায় ও মধুমিতা মজুমদারের তোলা ছবি।