চোদ্দো বছর ধরে রিকশায় থমকে শহর

কোথায় গেল রসনা রসিয়ে তোলা সেই সব মিষ্টি? কোথায় ঘাসে চাপা পড়ে রইল ইতিহাস? রিকশা চড়ে কোন পথে চলেছে এই শহর? খোঁজ নিচ্ছে আনন্দবাজার।বহু দিন আগে এক ফরাসি মহিলা এ শহরের নাম দিয়েছিলেন ‘রিকশার শহর’। সেই শুরু। তারপরে আড়ে-বহরে শহর বেড়েছে। বেড়েছে লোকসংখ্যা। বাইরে থেকে কর্মসূত্রে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। শুধু রিকশার দাপাদাপিতে বর্ধমান রয়ে গিয়েছে বর্ধমানেই। ঘণ্টাখানেক শহরে ঘুরলেই পুরনো স্মৃতিসৌধের পাশাপাশি চোখে পড়বে সরু রাস্তা, প্রবল যানজট আর রাস্তা জুড়ে হকারদের দাপাদাপি।

Advertisement

রানা সেনগুপ্ত

বর্ধমান শেষ আপডেট: ০৭ অগস্ট ২০১৪ ০১:৪৪
Share:

রিকশার সারি শহরে।

বহু দিন আগে এক ফরাসি মহিলা এ শহরের নাম দিয়েছিলেন ‘রিকশার শহর’। সেই শুরু।

Advertisement

তারপরে আড়ে-বহরে শহর বেড়েছে। বেড়েছে লোকসংখ্যা। বাইরে থেকে কর্মসূত্রে বা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বেড়েছে পাল্লা দিয়ে। শুধু রিকশার দাপাদাপিতে বর্ধমান রয়ে গিয়েছে বর্ধমানেই।

ঘণ্টাখানেক শহরে ঘুরলেই পুরনো স্মৃতিসৌধের পাশাপাশি চোখে পড়বে সরু রাস্তা, প্রবল যানজট আর রাস্তা জুড়ে হকারদের দাপাদাপি। এবং অবশ্যই রিকশাযা ছাড়া শহরটাই যেন অসম্পূর্ণ। এ শহরে এলে আপনি মোটরবাইক পাবেন, শহরের দু’প্রান্তের বাসস্ট্যান্ড থেকে দূরে যাওয়ার বাস পাবেন। ভাড়া গাড়িও পাবেন। কিন্তু, শহরের ভেতর চলাফেরার ভরসা একটাইরিকশা!

Advertisement

শহরের অলিগলিতে কান পাতলে রিকশাওয়ালাদের নিয়ে অনেক মজার গল্পও শোনা যায়। একবার নাকি এক যাত্রী বর্ধমানের বিজয়তোরণ এলাকায় নেমে এক রিকশাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “ভাই, বিশ্ববিদ্যালয় যাবেন?” রিক্সাওয়ালা তাঁকে রীতিমত ধমকে উত্তর দিয়েছিলেন, “ওসব খটমট ইংরেজি বলেন কেন? সোজা বাংলায় বলতে পারেন না, ইউনির্ভাসিটি যাবেন?” শহরের খোসবাগান এলাকায় একাধিক চিকিৎসকের চেম্বারে প্রায় ধরে ধরে রোগী নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও সুনাম আছে কিছু রিকশাওয়ালার। বহু রোগী তো বটেই এর ফল ভুগেছিলেন এক চিকিৎসকের স্ত্রীও। একবার শহরের এক স্বনামধন্য চিকিৎসকের স্ত্রী বর্ধমান রেল স্টেশনে নেমে সেই চিকিৎসকের চেম্বারে যেতে চাইলে তাঁকে নানা পথ ঘুরিয়ে রিকশাওয়ালা সটান অন্য এক চিকিৎসকের চেম্বারে নিয়ে আসেন। মহিলা আপত্তি করতে সেই রিকশাওয়ালা বলেন, “আরে অমুক ডাক্তার তো বুড়ো হয়ে গিয়েছে। এই ডাক্তার তরুণ। ইনিই ভাল চিকিৎসা করবেন।”

ঢিমে তালে চলা এ শহরের যাতায়াতের ভরসা রিকশা আবার ফাঁসও হয়ে ওঠে। কর্মব্যস্ত সকালে সবাই যখন গতি বাড়াচ্ছে তখন হাজার হাজার রিকশার দাপটে রাস্তাঘাট জ্যামজমাট। কার সাধ্য সে ফাঁস পেরিয়ে এগোয়! তবে পুরসভা অনুমোদিত রিকশার সংখ্যা কিন্তু মাত্র ১৪১৪। তাতে কী? আশপাশের পঞ্চায়েত এলাকা থেকে সকাল-বিকেল আরও হাজারখানের নম্বর প্লেটবিহীন রিকশা ঘুরে বেড়ায় শহরে। আর ভাড়া? সে তো সোনার দরের মতোই বাড়ছে এবং বাড়ছে। এমনকী যদি আপনি বর্ধমান শহরের বাসিন্দাও হন এবং বর্ধমান স্টেশনে নেমে গুটিগুটি পায়ে রিকশা স্ট্যান্ডের দিকে এগিয়ে গন্তব্যে যাওয়ার কথা বলেন, তাহলে রিকশাওয়ালা নির্ঘাত আপনাকে বহিরাগত বলে ঘরে নেবেন। ভাড়া সম্পর্কে ধারণা নেই ভেবে আপনার চোখের আড়ালে আশপাশের রিকশাওয়ালাদের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে মুচকি হাসবেনও হয়তো। তারপরেই ৫০, ৬০, ৭০। ভাড়া শুনে ভিড়মি খাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না আপনার।

সঙ্গে জুটি বেঁধেছে নম্বরপ্লেটবিহীন রিকশা ও বৈকুন্ঠপুর, রায়ান থেকে আসা পঞ্চায়েতের রিকশা।

তবে এক সময় বর্ধমানের রিকশা ভাড়ার তালিকা শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিতে টাঙানো থাকতো। পুরসভার তরফে ২০০০ সালে শেষবার রিকশাভাড়া তালিকা ছাপা হয়েছিল। তারপর ১৪ বছরে বনবাস কাটিয়ে রামচন্দ্র দেশে ফিরলেও রিকশা ভাড়ায় লাগাম পরানোর কথা ভাবেননি কেউ। ফলে কুড়ি টাকার জায়গায় অনায়াসে পঞ্চাশ টাকা চাইছেন একদল রিকশাওয়ালা। পুরসভার অবশ্য দাবি, এরা বেশিরভাগই বাইরের গ্রাম এলাকা থেকে শহরে রিকশা চালাতে আসেন। পুরসভার আরও দাবি, কাছেপিঠের পঞ্চায়েত এলাকা থেকে গাদা গাদা শহরে ঢোকাতেই যানজট বাড়ছে। এই রিকশাগুলির বেশিরভাগই নম্বরবিহীন।

২০১১ সালে পুরসভায় ক্ষমতার হাতবদলের পরেও ওই নম্বরপ্লেটবিহীন রিকশা বা পঞ্চায়েত থেকে আসা রিকশার উপর রাশ টানা যায়নি। তবে বাম আমলে নিয়ন্ত্রণ হত বলেই দাবি প্রাক্তন পুরপ্রধান আইনূল হকের। তিনি বলেন, “আমরা ক্ষমতায় থাকাকালীন ওই রিকশাগুলি আটকানোর চেষ্টা করা হত। শহরে ঢুকলে জরিমানা করা হত। পুরসভার গুদামে আটকেও রাখা হতো।” তাঁর দাবি, “আমরা আরও ৫০০ রিকশাকে লাইসেন্স দিতে চেয়েছিলাম। তাতে শহরের বুকে অবৈধ রিকশা কমত।”

সিটু অনুমোদিত রিকশা ইউনিয়নের নেতা তরুণ রায় বলেন, “এখন বেআইনি রিকশায় শহর ছেয়ে গিয়েছে। আমরা ইউনিয়নের তরফে প্রস্তাব দিয়েছিলাম, পঞ্চায়েতের রিকশা শহরে ঢুকলেও তাদের নির্দিষ্ট সীমানায় যাত্রী নামিয়ে ফিরে যেতে হবে। একমাত্র হাসপাতাল বা নার্সিংহোমের রোগীদের নিয়ে ওই রিকশা শহরে ঢুকতে পারতো। তবে সেসব কিছুই মানা হয় না।” শহরে গত ৩০ বছর রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়নি বলেও তাঁর দাবি।

বর্ধমান পুরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর তথা দলের রিকশা ইউনিয়নের নেতা সেলিম খানও মেনে নিয়েছেন যে শহরে পুরসভার লাইসেন্সপ্রাপ্ত রিকশার প্রায় তিন গুন রিকশা বিনা লাইসেন্সের। তার উপর পঞ্চায়েতের হাজার হাজার রিকশা এখানে ঢোকে ও সারাদিন দাপিয়ে বেড়ায়। তাঁর আশ্বাস, “এদের নিয়ন্ত্রনে আমরা ব্যবস্থা নেব।” পুরসভা সূত্রেও জানানো হয়েছে, শীঘ্রই নতুন রিকশা ভাড়ার তালিকা প্রকাশিত হতে চলেছে। তাতে বলা হবে, রিকশায় চাপলেই দিতে হবে ১০ টাকা। তারপরে প্রতি কিলোমিটারে তা পাঁচ টাকা করে বাড়বে। সামনের বোর্ড মিটিংয়ে এমন প্রস্তাব নেওয়া হবে বলেও জানা গিয়েছে। তবে প্রস্তাব অনুমোদন পেয়ে বাস্তবায়িত কবে হবে, সে খবর কেউ রাখে না। উত্তর নেই, পঞ্চায়েতের রিকশা নিয়ন্ত্রণে কী উদ্যোগ নেওয়া হবে, তারও।

পুরসভা যানজট রুখতে শহরের একটা বড় অংশের মধ্যে দিয়ে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে। টোটোগুলি চললেও যাত্রী তেমন হয় না। অগত্যা রিকশার ভরসাতেই চলছে শহর।

ছবি: উদিত সিংহ

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন