শিয়ালদহ-বনগাঁ লাইনে হাবড়া স্টেশনের ফ্লাইওভারের উপর দিন পনেরো ধরে দেখা যাচ্ছিল এদের। এক মহিলা একটি বাচ্চা ছেলেকে ছেঁড়া কাপড়ের উপর শুইয়ে রেখে ভিক্ষা করছিলেন। কেউ কিছু জানতে চাইলে বলছিলেন, এটি তাঁর ছেলে। গুরুতর অসুস্থ। থাকেন হাবড়ার হিজলপুকুরে।
গোবরডাঙা প্রীতিলতা বয়েজ স্কুলের শিক্ষিকা রমা রায় স্কুলে যাতায়াতের পথে এই দৃশ্য দেখে দু’দিন টাকাও দেন। আজ শনিবার সকাল দশটা নাগাদ স্কুলে যাওয়ার পথেও দেখতে পান, একই অবস্থায় ভিক্ষা করছেন সেই মহিলা। বাচ্চাটির কী হয়েছে জানতে চান তিনি। মহিলা জানান, ছেলের ব্রেন টিউমার হয়েছে। কী চিকিৎসা করানো হচ্ছে জানতে চাইলে বলেন, প্রতিদিন এসএসকেএম হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে ইনজেকশন দিয়ে আনেন।
কথাবার্তা বলতে গিয়ে শিক্ষিকার সন্দেহ হয়। চিকিৎসার কাগজ দেখতে চাইলেই মহিলা হঠাত্ বাচ্চাটিকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। শিক্ষিকা দৌঁড়ে ধরে ফেলেন ওই মহিলাকে। ছুটে আসেন আরও লোকজন। স্টেশন সংলগ্ন জিআরপি ফাঁড়িতে নিয়ে যাওয়া হয় বাচ্চা সহ মহিলাকে।
এর পর স্টেশন মাস্টারকে ফোন করে সমস্ত ঘটনা জানানো হয়। জিআরপি-র জেরায় মহিলা জানান তাঁর বাড়ি বারাসতে। জিআরপি ওই মহিলাকে হাবড়া স্টেশনে ভিক্ষা করতে বারণ করে এলাকা ছেড়ে চলে যেতে বলে। কিন্তু বাধা দেন শিক্ষিকা। কারণ তাঁর সন্দেহ হয়, বাচ্চাটি আদৌ কি ওই মহিলার ছেলে! শিক্ষিকাই জিআরপি-কে চাপ দেন, মহিলাকে ছেড়ে দেওয়ার আগে বাচ্চাটির আসল পরিচয় তদন্ত করে জানতে হবে। এবং বাচ্চটির চিকিৎসার ব্যবস্থাও করতে হবে। জিআরপি-র তরফে ওই শিক্ষিকাকে বনগাঁয় গিয়ে লিখিত অভিযোগ করতে বলা হয়।
আরও পড়ুন- শূন্য চোখ দেওয়ালে, ছবিতেই নিশ্চিন্দি বিধু-র
ইতিমধ্যেই আশেপাশে বহু মানুষ ভিড় জমাতে শুরু করেন। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়। ওই মহিলা প্রথমে বলেছিলেন তার বাড়ি বারাসতে, পরে আবার বলেন উল্টোডাঙ্গায়, কখনও বলেন মানিকতলায়। সন্দেহ বাড়তে থাকে। আর একটু চাপ দিতেই মহিলা জানান, এটি তাঁর নিজের নয় বোনের ছেলে।
ইতিমধ্যে ওই শিক্ষিকা বাচ্চাটির মুখে পরিয়ে রাখা মাস্কটি খুলে দেন। এবং কিছু ক্ষণ পর অবাক হয়ে লক্ষ্য করেন, এত ক্ষণ ধরে ঝিমিয়ে থাকা বাচ্চাটি ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠে কথা বলতে পর্যন্ত শুরু করেছে। বাচ্চাটি জানায় ওই মহিলাকে ও বড়মা বলে ডাকে। বাড়ি ওড়িশায়। কিন্তু এখন থাকে হেদুয়ার এক বাড়িতে। ওর মত আরও অনেক বাচ্চা হেদুয়ার সেই বাড়িতে থাকে বলেও জানায় ছেলেটি।
একে একে তার পর যা বেরিয়ে আসে তা ভয়ঙ্কর। রোজ রাতে নাকি সব বাচ্চাকে ইনজেকশন দেওয়া হয়। সকালে বিভিন্ন স্টেশনে এক একজন মহিলা এক একটি শিশুকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন। ছেলেটি জানায়, মুখের উপর ওই মাস্ক দেওয়া থাকলেই ওদের ঘুম ঘুম ভাব চলে আসে। দুপুরে কিছু খেতে দেওয়া হয় না। টাকা ভাল রোজগার না হলে খেতে দেওয়া হয় না রাতেও। বাচ্চাটি যাকে মা বলে, ওই মহিলা তাঁকে প্রতিদিন ২০০ টাকা করে দেন। মহিলার কাছ থেকে একটি দামি মোবাইলও উদ্ধার হয়। পরে চাইল্ড লাইনেও ফোন করা হয়। চাইল্ড লাইনে তরফে প্রকাশ দাস নামের এক জন গোটা বিষয়টি তদারকি করছেন। তিনিই ওই মহিলাকে বনগাঁ জিআরপিতে নিয়ে যান। আপাতত সেখানেই আটক রাখা হয়েছে মহিলাকে। বনগাঁ জিআরপিতেই লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন শিক্ষিকা।