CPM State Conference

নেতৃত্বকে গ্রাস করছে ভয়, কর্মীদের মনে ঘোর সংশয়, সিপিএমের রাজ্য সম্মেলনের নথিতে দুর্বলতার ফিরিস্তি

সিপিএমের ২৭তম রাজ্য সম্মেলন শুরু হবে আগামী শনিবার। সূত্রের খবর, রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম যে প্রতিবেদন পেশ করবেন সম্মেলনে, তার ছত্রে ছত্রে রয়েছে সাংগঠনিক দুর্বলতার উল্লেখ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন সংবাদদাতা

শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ১৭:৫৯
Share:

সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। —ফাইল ছবি।

ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর বঙ্গ সিপিএমের চার-চারটি সম্মেলন পর্ব হয়ে গিয়েছে। প্রতি বারেই ঘুরে দাঁড়ানোর কথা বললেও বাস্তবে তা হয়নি। বরং ভোটের নিরিখে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে ১৪ বছর আগে রাজ্য চালানো পার্টি। সেই সিপিএমের ২৭তম রাজ্য সম্মেলন শুরু হতে চলেছে আগামী শনিবার থেকে। সূত্রের খবর, রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম যে প্রতিবেদন পেশ করবেন ডানকুনিতে অনুষ্ঠিতব্য সম্মেলনে, তার ছত্রে ছত্রে রয়েছে সাংগঠনিক দুর্বলতার উল্লেখ। যেখানে উল্লেখ করা হয়েছে নেতৃত্বের একাংশের মধ্যে যেমন ‘ভয়ভীতি’ কাজ করছে, তেমনই কর্মীদের মধ্যেও রয়েছে ঘোর ‘সংশয়’। দলের তরফে যে কাজ করার কথা বলা হয়েছিল, বিশেষত বুথ স্তরের সংগঠন গড়ার প্রশ্নে যে ভূমিকা নেওয়া উচিত ছিল, সে ক্ষেত্রে ‘গুরুতর দুর্বলতা’ রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

Advertisement

প্রতিবেদনের ৪০-৪৭ নম্বর পৃষ্ঠার মধ্যে সংগঠন বিষয়ক দুর্বলতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রাজ্য সম্মেলনের আগে শাখা, এরিয়া এবং জেলা স্তরের সম্মেলন প্রক্রিয়া শেষ করেছে সিপিএম। একাধিক জেলা সম্মেলনে কোন্দলও প্রকাশ্যে এসেছে। সার্বিক ভাবে সে সবও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।

নেতাদের ভয়

Advertisement

জেলা সম্মেলন থেকে রাজ্য সম্মেলন যে নির্যাস পেয়েছে তার অন্যতম হল, নেতৃত্বের একটা অংশের মধ্যে তৃণমূল এবং বিজেপি-বিরোধী লড়াইয়ে ভয়ভীতি কাজ করছে। সিপিএমে এই আলোচনা অনেক দিন ধরেই ছিল যে, দলীয় কাঠামোর মধ্যে নেতৃত্বের একটা বড় অংশ বাম জমানায় নেতা হয়েছিলেন। ফলে তাঁদের বিরোধী রাজনীতি করার কোনও পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পরেও একাংশের মানসিকতায় কোনও বদল নেই বলে নিচুতলায় অভিযোগও রয়েছে। রাজ্য সম্মেলনের রিপোর্টে তারই প্রতিফলন রয়েছে বলে মনে করছেন সিপিএমের প্রথম সারির নেতারা। সিপিএমের এক তরুণ নেতার কথায়, ‘‘আমাদের পার্টির এক নেতা আছেন, যাঁর কাজই হল আইন আমান্য বা কোনও বিক্ষোভ কর্মসূচিতে গিয়ে পুলিশের দিকে দাঁড়িয়ে পড়ে জমায়েতকে নির্দেশ দেওয়া— বসে পড়ুন! এই নেতারাই সব কমিটি দখল করে রেখেছেন। নিজেরা ক্ষমতা ভোগ করেছেন। এখন আর সেই ঠান্ডা ঘর ছেড়ে বেরোতে পারছেন না। দল ডুবছে।’’ তবে কিছু কিছু আন্দোলনে যে ‘প্রতিস্পর্ধী’ মেজাজ পরিলক্ষিত হয়েছে, তারও উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। সিপিএমের একটি তথ্য বলছে, যেখানে যেখানে সিপিএম গত কয়েক বছরে ‘জঙ্গি আন্দোলন’ করতে পেরেছে, সেখানে নেতৃত্ব দিয়েছেন হয় কম বয়সিরা, না হয় কৃষক বা ক্ষেতমজুর অংশ থেকে উঠে আসা নেতারা। ‘পলায়নী প্রবৃত্তি’ দেখা গিয়েছে মধ্যবিত্ত অংশের মধ্যেই।

কর্মীদের সংশয়

২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচন থেকে ২০২৪ সালের লোকসভা ভোট পর্যন্ত বার বার কংগ্রেস, আইএসএফের সঙ্গে বোঝাপড়া করে ভোটে লড়েছে সিপিএম। কিন্তু ভোটের আগে জোট তৈরি হওয়া, ভোট ফুরোলে সেই বোঝাপড়া উবে যাওয়া যে কর্মীদের মনে সংশয় তৈরি করেছে, তারও স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে প্রতিবেদনে। গত কয়েক বছর ধরে সিপিএমের একটা বড় অংশের দলীয় সদস্য এই ‘মরসুমি’ জোটের বিরোধিতা করলেও রাজ্য নেতৃত্ব গা করেননি। তবে সেলিম সোজা কথা সোজা ভাবে বলতে চাইছেন বলেই মনে করছেন দলের অনেকে।

বুথে ভূত

রাজ্য সিপিএমে একটা চালু কথা রয়েছে, ‘আমাদের যত লোক ফেসবুক করে, তত লোক বুথে বসলে দলের এই হাল হত না।’ বুথ স্তরে সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেই যে আসল ‘ভূত’ রয়েছে এবং কোনও ঝাড়ফুঁকেই যে তা যাচ্ছে না, তা-ও খোলাখুলি বলা হয়েছে প্রতিবেদনে। সিপিএমের এই ‘দুর্দিনে’ও দেখা গিয়েছে একাধিক জায়গায় নেতা হওয়ার লড়াই চলছে। যে পার্টিতে বুথে লোক নেই, সেই পার্টির নেতা হওয়ার জন্য এত আকাঙ্ক্ষা কেন, তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে দলের মধ্যেই। ধারাবাহিক নির্বাচনী বিপর্যয় এবং জনসমর্থনে হ্রাস যে বুথের দুর্বলতার ফলে হচ্ছে, তা-ও উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে। গরিব মানুষ এবং বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর থেকে যে দল বিচ্ছিন্ন, সেই বিচ্ছিন্নতা যে কাটানো যাচ্ছে না, তা-ও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে প্রতিবেদনে।

নিশানায় দুই ২৪ পরগনা

এ বারের সম্মেলন পর্বে দুই ২৪ পরগনায় বেনজির কোন্দল দেখা গিয়েছে। দক্ষিণে নাম প্রত্যাহারের হিড়িক এবং উত্তরে ভোটাভুটি এবং বিদায়ী জেলা সম্পাদকের হেরে যাওয়া সিপিএমে দ্বন্দ্বের নতুন মাইলফলক তৈরি করেছে। এবং এই দুই জেলাতেই নেতাদের ছড়াছড়ি। রাজ্য সম্মেলনের প্রতিবেদনে নেতৃত্ব স্তরের ‘অনৈক্য’কেই কোন্দলের জন্য দায়ী করা হয়েছে। পাশাপাশিই মালদহ, পূর্ব মেদিনীপুরের মতো যে যে জেলায় নিয়ম লঙ্ঘন করে সম্পাদক নির্বাচন হয়েছে বা কোচবিহারের সম্পাদক নির্বাচনে বয়সবিধি না মানার ঘটনা ঘটেছে, সেখানেও অনতিবিলম্বে বদলের কথা বলা হয়েছে রিপোর্টে।

কমতি-বাড়তি

প্রতিবেদনের ৪১ নম্বর পাতায় উল্লেখ করা হয়েছে, গত তিন বছরে সারা রাজ্যে ২৫ হাজার জনের পার্টি সদস্যপদ খারিজ করেছে দল। তবে পরের পৃষ্ঠায় দেওয়া তথ্যপঞ্জিতে দেখা যাচ্ছে, সিপিএমের পার্টি সদস্যপদ যত কমেছে, তার চেয়ে অন্তর্ভুক্তির হার বেশি। যাকে অন্ধকার সুড়ঙ্গে একচিলতে আলো বলে অভিহিত করছেন অনেকে। প্রতিবেদনে উল্লিখিত তথ্য বলছে, ২০২২ সালের পুনর্নবীকরণ পর্বে ১১ হাজার সদস্যপদ খারিজ হয়েছিল। মোট সদস্যসংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ৫৪ হাজার। তার পরের বছর, অর্থাৎ ২০২৩ সালের পুনর্নবীকরণে ৫,৮০০-র মতো সদস্যপদ খারিজ হলেও মোট সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৫৭ হাজার। অর্থাৎ, অন্তর্ভুক্তি হয়েছে বেশি। ২০২৪ সালে সদস্যপদ খারিজ হয় ৮,৪০০ জনের। তবে মোট সদস্যসংখ্যা দাঁড়ায় ১ লক্ষ ৫৮ হাজারে। উল্লেখ্য, সেলিম রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পরে তরুণদের অগ্রাধিকার দেওয়াকে আগ্রাসী ভাবে প্রয়োগ করার চেষ্টা করেছেন দলে। পার্টির অনেকের বক্তব্য, এই বৃদ্ধির হার তারই প্রতিফলন। যদিও প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে, এর মধ্যে কয়েক হাজারের ক্ষেত্রে এমনও হয়েছে, যাঁরা সদস্যপদ পাওয়ার এক বছরের মধ্যেই তা ছেড়েও দিয়েছেন। যা ‘উদ্বেগজনক’।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement