অভিযুক্তদের বেকসুর খালাসের রায় চ্যালেঞ্জ করার অধিকার আছে নির্যাতিতার, মত কলকাতা হাই কোর্টের। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন সহ্য করতে না-পেরে আইনি লড়াইয়ের পথে হেঁটেছিলেন বধূ। কিন্তু আদালত তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছে। ধরা পড়ার পরেও প্রমাণের অভাবে বেকসুর খালাস পেয়ে গিয়েছিলেন তাঁর শ্বশুরবাড়ির লোকজন। এ বার তাঁদের বিরুদ্ধে সরাসরি হাই কোর্টে মামলা করেন পুরুলিয়ার নির্যাতিতা। আদালত জানাল, অভিযুক্ত বেকসুর খালাস হলেও সেই রায় চ্যালেঞ্জ করার অধিকার নির্যাতিতা বা যে কোনও ভুক্তভোগীর রয়েছে। এতে আলাদা করে আদালতের অনুমতি নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। নির্যাতিতা বধূর মামলাটি আগামী অক্টোবর মাসে শুনবে উচ্চ আদালত।
ট্রায়াল কোর্ট বা হাই কোর্টের রায়ে কোনও অভিযুক্ত ছাড়া পেলে রাজ্য এবং মামলাকারী আবার আপিল করতে পারতেন। ভুক্তভোগী বা নির্যাতিত যদি মামলাকারী না হন, তা হলে আবেদন করতে পারতেন না। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে, অভিযুক্ত ছাড়া পেয়ে গেলে ভুক্তভোগী বা নির্যাতিতেরও রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনের অধিকার রয়েছে। শীর্ষ আদালতের বিচারপতি বিভি নাগরত্ন এবং বিচারপতি কেভি বিশ্বানাথনের বেঞ্চ অপরাধবিধির ৩৭২ ধারা অনুযায়ী ওই অধিকারের কথা জানায়। বলা হয়, নির্যাতিতের মৃত্যু হলে তাঁর বৈধ উত্তরাধিকারী রায় চ্যালেঞ্জের অধিকার পাবেন। পুরুলিয়ার মামলাটির ক্ষেত্রেও সেই অধিকার প্রযোজ্য, জানিয়েছে হাই কোর্ট। মঙ্গলবার বিচারপতি দেবাংশু বসাক এবং বিচারপতি মহম্মদ শব্বর রশিদির ডিভিশন বেঞ্চে এই মামলার শুনানি হয়েছে।
২০২০ সালে পুরুলিয়ার এক থানায় স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির লোকজনের বিরুদ্ধে নির্যাতন, খুনের চেষ্টার মামলা করেছিলেন বধূ। তাঁর বক্তব্য ছিল, ২০১৫ সালে বিয়ের সময় শ্বশুরবাড়িকে যৌতুক হিসাবে নগদ ছ’লক্ষ টাকা, ৯ ভরি সোনা এবং আসবাবপত্র দেওয়া হয়েছিল তাঁর বাপের বাড়ি থেকে। কিন্তু তার পরেও নানা সময়ে নানা ‘আবদার’ করতেন স্বামী কিংবা শ্বশুর-শাশুড়ি। তা পূরণ করতে না পারলে চলত শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার। ওই বধূ অসুস্থ সন্তানের জন্ম দেওয়ার পর নির্যাতন আরও বেড়ে যায় বলে অভিযোগ। বধূ জানিয়েছেন, তাঁর শ্বশুর এক বার তাঁর শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। তাতে বাধা দিলে মুখে বালিশ চাপা দিয়ে তাঁকে খুন করার চেষ্টা করা হয়। এর পরেই আইনি লড়াইয়ের পথে হাঁটেন নির্যাতিতা।
বধূর অভিযোগের ভিত্তিতে স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি-সহ পরিবারের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে চার্জশিট জমা দিয়েছিল পুলিশ। কিন্তু পুরুলিয়ার আদালত তাঁকে বেকসুর খালাস ঘোষণা করে। জানায়, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রমাণ যথেষ্ট নয়। এর পর কলকাতা হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন নির্যাতিতা। তাঁর শ্বশুরবাড়ির তরফে উচ্চ আদালতে এই মামলার গ্রহণযোগ্যতা নিয়েই প্রশ্ন তোলা হয়। তাঁদের আইনজীবী জানান, নির্যাতিতা সরাসরি এ ভাবে নিম্ন আদালতের রায়কে চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না। ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী, এর জন্য হাই কোর্ট থেকে আগে অনুমতি নিতে হয়। তা ছাড়া, যে আদালত এই রায় দিয়েছে, সেখানেই তা চ্যালেঞ্জ করা উচিত।
উভয়পক্ষের বক্তব্য শোনার পর হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ, শ্বশুরবাড়িতে বধূ যে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, তা স্পষ্ট। অভিযুক্তদের খালাস করে দেওয়া হয়েছে। ফলে ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৭২ ধারা অনুযায়ী রায় চ্যালেঞ্জের অধিকার নির্যাতিতার রয়েছে। কার্যবিধির ৩৭৮ নম্বর ধারাটি কেবল রাজ্য, তদন্তকারী সংস্থা বা মামলাকারীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু ৩৭২ নম্বর ধারা নির্যাতিতাকেও রায় চ্যালেঞ্জের অধিকার দেয়।
আদালত আরও জানিয়েছে, অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে যে ধারায় মামলা রুজু করা হয়েছে, তাতে দোষ প্রমাণিত হলে সর্বোচ্চ ১০ বছর কারাদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতে পারে। সেই কারণে এই মামলা হাই কোর্ট শুনবে। ১০ বছরের কম শাস্তি হবে, এমন মামলা হলে তা নিম্ন আদালত শুনতে পারত। ফলে ওই নির্যাতিতার আবেদন গ্রহণ করেছে হাই কোর্ট।
সম্প্রতি ৫৮ পৃষ্ঠার রায়ে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি নাগরত্ন জানিয়েছেন, অভিযুক্ত দোষী সাব্যস্ত হলে তাঁর যেমন রায়ের বিরুদ্ধে আবেদনের অধিকার রয়েছে, তেমনই নির্যাতিতের অধিকারকে ওই একই জায়গায় রাখা উচিত। অভিযুক্তের সাজা লঘু হলে বা অভিযুক্ত নির্দোষ প্রমাণিত হলে সেই রায়ের বিরুদ্ধে আবেদন করার অধিকার রয়েছে নির্যাতিত বা ভুক্তভোগীর। মামলাকারী বা রাজ্য চ্যালেঞ্জ না করলেও নির্যাতিত সেই অধিকার পাবেন।