নাবালকেরাও চাইতে পারবে জামিন, জানাল কলকাতা হাই কোর্ট। —প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র।
দেশে প্রাপ্তবয়স্কেরা অপরাধ করলে বা অভিযুক্ত হলে আদালত থেকে আগাম জামিন নিতে পারেন। কিন্তু নাবালকেরা এত দিন তা পারত না। শুক্রবার কলকাতা হাই কোর্ট জানাল, নাবালকেরাও আগাম জামিন পেতে পারবে। ভারতের কোনও হাই কোর্ট এর আগে এই রায় দেয়নি। কলকাতা হাই কোর্টের বিচারপতি জয় সেনগুপ্ত, বিচারপতি তীর্থঙ্কর ঘোষ, বিচারপতি বিভাস পট্টনায়েকের নেতৃত্বাধীন বৃহত্তর বেঞ্চ শুক্রবার নাবালকদের জন্য আইনের নতুন পথ খুলে দিয়েছে।
রঘুনাথগঞ্জ থানায় একটি অপরাধের মামলা হয়। সেই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে চার জন ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক (জুভেনাইল)। তাদের বিরুদ্ধে গুরুতর ধারায় অভিযোগ আনা হয়—৩০২ (খুন), ৩০৭ (হত্যার চেষ্টা) ইত্যাদি। তারা গ্রেফতার হওয়ার ভয় পাচ্ছিল। এই কারণে তারা আগাম জামিন (অ্যান্টিসিপেটরি বেল) চায়। প্রশ্ন ওঠে, অপরাধবিধির ৪৩৮ ধারা (আগাম জামিন) কি শিশুদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য? সওয়ালে উঠে এসেছে, যে এই আইনে বলা হয়েছে, ‘যে কেউ’ আগাম জামিন চাইতে পারেন। এখানে কোথাও বলা নেই, যে অপ্রাপ্তবয়স্কেরা তা পারবে না। অর্থাৎ অপরাধবিধিতে নাবালকদের জামিন চাওয়ার বিষয়ে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই।
জুভেনাইল জাস্টিস (জেজে) আইন, ২০১৫ কী বলে?
১) শিশুকে গ্রেফতার করা যায় না
২) শিশু হলে তাকে আটক করা হয়
৩) তাকে কখনই জেল বা লকআপে রাখা যাবে না
৪) শিশুদের সাধারণত জামিন দেওয়া বাধ্যতামূলক
কিন্তু জেজে আইনে কোথাও বলা নেই—
১) ‘শিশুরা আগাম জামিন চাইতে পারবে না’
২) বা অপরাধবিধির ৪৩৮ ধারা (আগাম জামিন) তাদের জন্য প্রযোজ্য নয়।
মামলাকারীদের আইনজীবী অয়ন ভট্টাচার্যের বক্তব্য, স্বাধীনতার অধিকার (সংবিধানের ২১ ধারা) সকলের— শিশুদেরও। আগাম জামিন বাচ্চাদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত। কোনও নাবালক আটক হওয়ার পরে কী হবে, তা বলে জুভেনাইল জাস্টিন আইন। আটক হওয়ার আগে কী হবে, তা বলে না। তাই গ্রেফতার হওয়ার আগেই সুরক্ষা চাইলে ৪৩৮ ধারা ব্যবহার করা যাবে। রাজ্যের আইনজীবী দেবাশিস রায়ের বক্তব্য, ‘‘অপরাধবিধির ৪৩৮ ধারায় ‘যে কেউ’ মানে সকলে। জুভেনাইল জাস্টিস তাকে বাধা দেয়নি। আটক হওয়ার আগে সুরক্ষা বাচ্চারাও পাবে। শিশুদের ‘সুরাহা-হীন’ রাখা যায় না।’’ কেন্দ্রের আইনজীবী অরুণকুমার মাইতির বক্তব্য, ‘‘জুভেনাইল জাস্টিস আইন আটক হওয়ার আগের অবস্থার কথা বলে না। তাই অপরাধবিধির ৪৩৮ ধারা বাধা ছাড়াই প্রযোজ্য। শিশুদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতা রক্ষা করা জরুরি।’’
কলকাতা হাই কোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চের পর্যবেক্ষণ—
এক, অপরাধবিধিতে ‘যে কেউ’ শব্দ আছে, শিশুরাও তার মধ্যে পড়ে। আইন শিশু এবং প্রাপ্তবয়স্কদের আলাদা করেনি।
দুই, জুভেনাইল জাস্টিস আইন গ্রেফতারির আগে কী হবে, তা বলে না। আইন শুধু বলে— আটক করার পরে কী ভাবে বাচ্চাকে রাখা হবে। কোথায় পাঠানো হবে। কী ভাবে জামিন দেওয়া হবে। কিন্তু গ্রেফতারের আগের পরিস্থিতির কথা বলে না।
তিন, আটক আসলে গ্রেফতারি। হাই কোর্টের পর্যবেক্ষণ, নাবালকদের গ্রেফতার না বলে আটক বলা হলেও উভয় ক্ষেত্রেই স্বাধীনতা হরণ হয়। তাই অপরাধবিধির ৪৩৮ ধারার যুক্তি এখানেও প্রযোজ্য।
চার, স্বাধীনতা সকলের জন্য, শিশুদেরও। আইন, মানবাধিকার এবং সংবিধান— সবাই বলে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা সর্বোচ্চ মূল্যবান। তাই প্রাপ্তবয়স্ক আগাম জামিন চাইতে পারলে, শিশুদের ক্ষেত্রে তা অস্বীকার করা যায় না।
আইনজীবীরা মনে করছেন, এই রায়ের ফলে কোনও শিশুকে অন্যায় ভাবে তুলে নিয়ে যাওয়া যাবে না। শিশুদেরও আগাম সুরক্ষা পাওয়ার অধিকার রয়েছে। আইন শিশুদের অধিকারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হল। তাঁরা মনে করেন, সারা দেশের জুভেনাইল মামলায় প্রভাব ফেলবে এই রায়।
তিন বিচারপতির মধ্যে বিচারপতি পট্টনায়েক রায়ে ভিন্ন মত পোষণ করেন। তাঁর পর্যবেক্ষণ, যেহেতু শিশুকে গ্রেফতার করা হয় না, শুধু আটক করা হয়, তাই অপরাধবিধির ৪৩৮ ধারা (যা গ্রেফতারের আশঙ্কা থাকলে আগাম জামিন দেয়) শিশুর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। শিশুকে আগাম জামিন দিলে জেজে আইনের উদ্দেশ্য নষ্ট হতে পারে। সে খারাপ লোকেদের সংস্পর্শে চলে যেতে পারে। শারীরিক বা মানসিক ভাবে বিপদের মুখে পড়তে পারে। পুনর্বাসনের প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। যদিও শেষ পর্যন্ত কলকাতা হাই কোর্ট জানিয়ে দিয়েছে, নাবালকেরাও আগাম জামিন পেতে পারবে।