মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ফাইল চিত্র।
ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) হলে বহু সংখ্যালঘু মানুষের নাম বাদ পড়বে। নতুন ওয়াকফ আইনে নানা সংখ্যালঘু প্রতিষ্ঠান বা কমিটির হাতে থাকা সম্পত্তি সরকারের হাতে চলে যাবে। এই জোড়া আশঙ্কার মুখে সংখ্যালঘুদের ‘আশ্বস্ত’ করতে চাইলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বার্তা, ‘‘প্রচারে কান দেবেন না। কালিদাস যে ডালে বসেছিল, সেই ডালই কেটেছিল। আপনারা সেটা করবেন না!’’
এসআইআর চলাকালীন সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত দুই জেলা মালদহ ও মুর্শিদাবাদে তাঁর বার্তা পৌঁছতে সশরীর এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। মালদহে ১২টি বিধানসভা কেন্দ্রের মধ্যে ৮টি এবং মুর্শিদাবাদে ২২টির মধ্যে ২০টিতে গত ২০২১ সালের ভোটে জয়ী হয়েছিল শাসক দল। দুই জেলায় তাঁদের সংখ্যালঘু সমর্থনের ভিতে যাতে কোনও আঁচড় না লাগে, আগামী বিধানসভা ভোটের বেশ আগে সে দিকে সতর্ক নজর রেখেছেন তৃণমূল নেত্রী। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, দুই জেলায় পরপর দু’দিনের কর্মসূচি থেকে মমতা এসআইআর এবং ওয়াকফ-প্রশ্নে আক্রমণের বর্শামুখ রেখেছেন বিজেপির দিকেই। কংগ্রেসের নাম করেননি, বামেদের কথাও তোলেননি। রাজনৈতিক শিবিরের একাংশের মতে, নিজেদের ভোট-ব্যাঙ্ক ধরে রাখার পাশাপাশি মেরুকরণের রাস্তাও খুলে রাখছে তৃণমূল। শাসক দলের নেতাদের অবশ্য পাল্টা যুক্তি, এসআইআর এবং ওয়াকফের ক্ষেত্রে কাঠগড়ায় আছে বিজেপিই!
রাজ্যে এসআইআর-এর গণনাপত্র জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত এলাকাই বেশি এগিয়ে। তার প্রেক্ষিতে মুখ্যমন্ত্রী মনে করছেন, পশ্চিমবঙ্গে এসআইআর নিয়ে বিজেপির ‘খেলা’র ফল উল্টো হতে চলেছে! সেই সূত্র ধরেই বহরমপুরে বৃহস্পতিবার তৃণমূলের সভায় মমতা বলেছেন, “ভোটার তালিকায় সংখ্যালঘুদের নাম উঠবে, বেশ হবে! কাগজ থাকলে নাম উঠবে। এখানে রোহিঙ্গা নেই।” এক সময়ে মুখ্যমন্ত্রী বলেছিলেন, এসআইআর-এর নামে কেউ তথ্য চাইলে দেবেন না। কিন্তু এখন তাঁর বক্তব্য, “কাগজপত্র ঠিকমতো জমা দিন। আমরা না করতে দিলে (এসআইআর) রাষ্ট্রপতি শাসন করত। মোটাভাইয়ের (অতীতে এ ভাবে ইঙ্গিত করেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দিকে) চালাকি বুঝেছেন?”
গণনাপত্র জমার পরে শুরু হবে এসআইআর-এর শুনানি-পর্ব। তার আগে মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, “শুনানিতে ডাকলে যাবেন। না গেলে নাম কেটে দেবে। আমরা সাহায্য করব। বুথে বুথে ক্যাম্প (দলের) করব। সরকারও সহায়তা শিবির করবে, যার যেটা (নথি) নেই, করে দেবে। বিজেপি গায়ের জোরে বাংলা দখল করবে মনে করে সংখ্যালঘু, আদিবাসী, মতুয়া তাড়াচ্ছে।” মমতার আহ্বান, “আপনারা কালিদাস হবেন না। বিজেপির ভাঁড়ার শূন্য করে দিন!” রাজ্যের সকলের গণনাপত্র জমা হওয়ার আগে তাঁর নিজের ফর্ম তিনি জমা দেবেন না এবং রাজ্যে কোথাও ডিটেনশন ক্যাম্প হবে না বলেও ফের ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
ওয়াকফ-প্রশ্নে তাঁদের অবস্থান স্পষ্ট করতেও আরও এগিয়েছেন মমতা। তাঁর ব্যাখ্যা, “আমরা কেন্দ্রের স্বৈরাচারী বিলের বিরুদ্ধে বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করেছিলাম। আমরা আসার আগেই ৮২ হাজার ওয়াকফ সম্পত্তি কেন্দ্রীয় পোর্টালে ছিল। আমরা করিনি। এখন সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে ‘উমীদ’ পোর্টালে আপলোড করতে হবে। আপলোড করবেন মোতোয়ালিরা, করে ওয়াকফ বোর্ডকে দেবে। কারও সম্পত্তি বেদখল হবে না। আমার কথা যদি বিশ্বাস করেন, তা হলে জানবেন আপনাদের জীবন, সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের।” মুখ্যমন্ত্রীর কথায়, “এর জন্য অনেক কুৎসা সহ্য করতে হয়। আমি রমজানে গেলে হিজাবি বলা হয়!” সংশোধিত ওয়াকফ আইনের প্রতিবাদকে ঘিরেই আট মাস আগে মুর্শিদাবাদের ধুলিয়ান, শমসেরগঞ্জ, সুতিতে অশান্তি বেধেছিল। সেই কথা মনে রেখেই মুখ্যমন্ত্রীর সতর্কবার্তা, “নতুন করে কোনও গোলমাল হোক, এনআইএ দিয়ে গ্রেফতার হোক, আমরা চাই না। এমন কিছু করবেন না, যাতে নিজেদের বিপদ হয়।”
মুখ্যমন্ত্রীকে অবশ্য বিঁধতে ছাড়ছেন না তাঁর বিরোধীরা। বিজেপির রাজ্য সভাপতি শমীক ভট্টাচার্যের কটাক্ষ, “মুখ্যমন্ত্রী হিজাব পরবেন কি না, এই নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। উনি নিজেই জানেন এখানে কবর থেকে উঠে এসে লোকে ভোট দিয়ে চলে যায়, পঞ্চায়েত অফিস বা ক্লাবে বিএলও-দের বসিয়ে এসআইআর ফর্ম পূরণ করা হয়। তাই নিজেই ডিটেনশন ক্যাম্পের প্রসঙ্গ তুলছেন!” বহরমপুরের প্রাক্তন সাংসদ, কংগ্রেসের অধীর চৌধুরীর দাবি, পশ্চিমবঙ্গে ২০০৬ সালে সাচার কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী এক লক্ষ ৪৮ হাজার ২৫৩টি ওয়াকফ সম্পত্তি ছিল। এখন কত আছে এবং কত বেদখল হয়েছে, তা নিয়ে শ্বেতপত্র প্রকাশ করুক রাজ্য। অধীরের কথায়, “রাজ্য সরকার ওয়াকফ নিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করল কোথায়? মোদী সরকারের দোহাই দিয়ে এখন ওয়াকফ পোর্টালে তথ্য দিতে বলা হচ্ছে, এর পরে কমিটির হাত থেকে সম্পত্তি সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যাবে। আমরা বলে রাখছি, সংখ্যালঘুদের অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা হলে রুখে দাঁড়াবই।”
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে