‘সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স’-এর নয়া নামকরণের বিজ্ঞপ্তি জারি হয়েছিল জুলাইয়ের শেষে। তবে তার আগেই ওই ভলান্টিয়ারদের উপরে নজরদারি শুরু করেছিলেন কলকাতা পুলিশের গোয়েন্দারা। ১০ জুলাই রানি রাসমণি রোডে ভলান্টিয়ারদের সমাবেশের পরেই গোয়েন্দা-রিপোর্ট জমা পড়ে নবান্নে। তার ভিত্তিতেই ‘পুলিশ’ শব্দটি ছেঁটে প্রশাসন তাঁদের নতুন নাম দেয় ‘সিভিক ভলান্টিয়ার্স’।
আর পুলিশ-তকমা বাতিলের ফরমান জারির পরে খুলে গিয়েছে প্রতিবাদের উৎসমুখও। পথে নামার ডাক দিচ্ছেন ভলান্টিয়ারেরা। পশ্চিম মেদিনীপুর সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অনিল দাস মঙ্গলবার বলেন, “আমাদের সদস্যদের থানায় ডেকে ভয় দেখানো হচ্ছে। কাজ কেড়ে নেওয়ারও হুমকি দেওয়া হচ্ছে। এর প্রতিবাদে আমরা আবার পথে নেমে আন্দোলন করব।”
ভলান্টিয়ারদের অভিযোগ, এত দিন তাঁরা মুখ বুজে কাজ করেছেন। কিন্তু ‘পুলিশ’ তকমা কেড়ে নিয়ে সরকার কার্যত তাঁদের সঙ্গে প্রতারণা করল। তাই এ বার মুখ খুলতে চান তাঁরা। তাঁদের এক জনের কথায়, “লোকসভা ভোটে রাত-দিন এক করে কাজ করেছিলাম। তৃণমূলের অনেক নেতাই আশ্বাস দিয়েছিলেন, চাকরি পাকা হবে। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, বেগার খাটলাম। ন্যূনতম মজুরিটাও পেলাম না।” শুধু যান-শাসন কিংবা মেলা-পার্বণে ভিড় সামলানো নয়। থানার বাবুদের ফাইফরমাশও খাটতে হতো বলে ভলান্টিয়ারদের অভিযোগ। জলপাইগুড়ির এক ভলান্টিয়ার বলেন, “মাসখানেক আগে ফালাকাটায় যান নিয়ন্ত্রণের সময় এক অফিসার রাস্তাতেই চড় মারেন আমাদের এক জনকে। নালিশ করেও লাভ হয়নি। তবু কিছু আয়ের আশায় আমরা মুখ বুজে সব সহ্য করেছি।”
পিঠ দেওয়ালে ঠেকে যাওয়ায় মুখ খোলার পথে যেতে হচ্ছে ওই ভলান্টিয়ারদের। বস্তুত, দাবিদাওয়া নিয়ে রানি রাসমণি রোডের সমাবেশে তাঁরা সরব হওয়ার পরেই সিঁদুরে মেঘ দেখতে শুরু করেছিল সরকার। ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে কেন্দ্র নির্ধারিত দৈনিক ন্যূনতম মজুরি ২০৬ টাকা। ওই ভলান্টিয়ারেরা তা-ও পান না। তাঁদের দেওয়া হয় ১৪১ টাকা ৮৫ পয়সা। তা-ও যে-দিন কাজ জোটে, ওই সামান্য মজুরি মেলে সে-দিনই। তাঁরা আর-পাঁচটা চাকরির মতো সুযোগ-সুবিধার দাবি করায় প্রমাদ গোনে প্রশাসন। রানি রাসমণি রোডে তাঁদের সমাবেশের পরে রাজ্য প্রশাসনের একাংশ যুক্তি দেখিয়েছিলেন, এটা শৃঙ্খলা ভাঙারই নামান্তর। পুলিশ-তকমা সেঁটে চাকরি করার কারণে মানুষ তাঁদের ওই বাহিনীরই অঙ্গ বলে ভাবে। ওই ভলান্টিয়ারেরা সমাবেশ করে সেই বাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙেছেন বলে মনে করেন প্রশাসনের ওই অংশ। তাই আর তাঁদের নামে ‘পুলিশ’ শব্দটা থাকা উচিত নয়।
শুধু কলকাতা পুলিশের নজরদারি নয়। রাসমণি রোডের সমাবেশে কোন কোন ভলান্টিয়ার অংশ নিয়েছিলেন, তারও তালিকা বানানোর নির্দেশ গিয়েছিল জেলার পুলিশ সুপারদের কাছে। বীরভূম পুলিশ সূত্রের খবর, সেই নির্দেশ পাওয়ার পরে সব থানার ওসি-কে ওই কাজের দায়িত্ব দিয়েছিল জেলা প্রশাসন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশকর্তা বলেন, “মূলত গরিব ঘরের ছেলেরা এই কাজ পেয়েছিল। মন না-চাইলেও সরকারি নির্দেশে ওই কাজ করতে বাধ্য হয়েছি আমরা।” নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সেখানকার এক ভলান্টিয়ার বলেন, “থানার বড়বাবু আমাদের পরিচয়পত্র দেখাতে নিষেধ করেছেন। এর পরে হয়তো সেগুলো জমা দিতে বলা হবে।”
লালবাজার নবান্নকে জানিয়েছিল, অসংগঠিত শ্রমিক সংগঠনের ব্যানার-ফেস্টুন নিয়ে মিছিল-মিটিং করলেও সিভিক ভলান্টিয়ারদের একাংশের সঙ্গে তলে তলে একটি নকশাল গোষ্ঠীর যোগ আছে। কলকাতার সমাবেশের পরে উত্তর ২৪ পরগনার বাদুতে ওই গোষ্ঠীর একটি শাখা সংগঠনের সঙ্গে জোট বেঁধে মিটিংও করেছেন তাঁরা। গত বছরের শেষ দিকে বাদুতেই সংগঠন গড়ার সিদ্ধান্ত নেন ভলান্টিয়ারেরা। পুলিশ জানায়, ওই নকশাল নেতারা রাসমণি রোডের সমাবেশেও হাজির ছিলেন। তাঁরাই সমাবেশের খরচখরচা জুগিয়েছিলেন।
তবে ওই সভাই ভলান্টিয়ারদের উপরে কোপ পড়ার একমাত্র কারণ বলে মনে করছেন না প্রশাসনের অন্য একটি অংশ। তাঁদের অভিযোগ, শাসক দলের প্রতি আনুগত্যে ঘাটতির কারণেই পুলিশ-তকমা কেড়ে নিয়ে ওঁদের ভলান্টিয়ার থেকে রাতারাতি নিছক স্বেচ্ছাসেবী বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এর পরে ধীরে ধীরে তাঁদের কাজ দেওয়াও বন্ধ হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন ওই অফিসারেরা।
এবং কাজ বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা যে পুরোপুরি অমূলক নয়, সে-কথা বলছেন সিভিক পুলিশ ভলান্টিয়ার্স সংগঠনের সভাপতি সঞ্জয় পড়িয়াও। মঙ্গলবার তিনি বলেন, “বিভিন্ন জেলা থেকে খবর এসেছে, এ দিন বহু ছেলেকে ডেকেও কাজ দেওয়া হয়নি। পুজোর মুখে এটা মানসিক পীড়ন ছাড়া কিছুই নয়।”
এই পরিস্থিতিতে অস্তিত্ব রক্ষার তাগিদেই মুখ খোলা ছাড়া পথ দেখছেন না ওই স্বেচ্ছাসেবকেরা।