এক জন ভেবে রেখেছেন, তৃণমূলের হাত যদি আবার ধরে তাঁর দল, কংগ্রেসে আর থাকা যাবে না! আর এক জনের আগাম হুঁশিয়ারি, বামেদের সঙ্গে যদি সত্যিই জোট হয় কংগ্রেসের, দলটা আর করবেন কি না ভাবতে হবে!
প্রথম জন আব্দুল মান্নান। সারদা-কাণ্ডে সিপিএমের আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্যকে নিয়ে যিনি সুপ্রিম কোর্টে আইনি লড়াই লড়েছেন এবং সিবিআই তদন্তের নির্দেশ আদায় করে এনেছেন। গণতন্ত্র বাঁচানোর আন্দোলনে বামপন্থী বিশিষ্টদের সঙ্গে নিয়েই পথে নেমেছেন। রাজ্যে তৃণমূলের শাসনের অবসান ঘটাতে পুরনো তিক্ততা ভুলে বামেদের কাছে নিতে হবে, প্রদেশ কংগ্রেসের মধ্যে এই মতের প্রবল প্রবক্তা। দ্বিতীয় জন মানস ভুঁইয়া। পুরনো ইতিহাস মনে রেখেই বামেদের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নে যাঁর আপত্তি তীব্র। বিধানসভার ভিতরে-বাইরে যাঁর নানা আচরণে তৃণমূলের প্রতি নরম বার্তা দেখতে পায় দলেরই একাংশ। কংগ্রেসের অন্দরে চর্চা আছে, আগামী বিধানসভা ভোটে দক্ষিণবঙ্গে যাঁরা ফের জয়ের ব্যাপারে সংশয়ে, তাঁরাই নাকি তৃণমূলের প্রতি দুর্বল!
তবে দু’জনের উদাহরণ থেকেই স্পষ্ট— আগামী বিধানসভা নির্বাচনে বামেদের সঙ্গে সমঝোতার প্রশ্নে প্রদেশ কংগ্রেসের মধ্যেও বিতর্ক
এবং বিভাজন কেমন তীব্র! সিপিএমের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য গৌতম দেব সমঝোতার সম্ভাবনা উস্কে দিতেই সামনে এসে পড়েছে কংগ্রেসের অন্দরের বিতর্কও। রেওয়াজে আবদ্ধ দল হিসাবে সিপিএমের নেতারা
বিতর্ক করছেন রাজ্য কমিটিতে। কংগ্রেস নেতারা তাঁদের দস্তুর মেনে কর্মিসভায় বা অন্য অবসরে নিজেদের মত সামনে আনছেন। প্রকাশের পদ্ধতি যা-ই হোক, বিতর্ক কিন্তু তুঙ্গে!
বস্তুত, গৌতমবাবু মুখ খোলার আগে থেকেই নিজের জেলায় নিজেদেরই পরিচালিত একটি পত্রিকায় মান্নান ধারাবাহিক কলম লিখছেন ‘নতুন করে ভাবতে হবে’। তাঁর যুক্তি, তৃণমূলের অপশাসন শেষ করতে বাম এবং কংগ্রেসের কাছাকাছি আসাই ভবিষ্যত হওয়া উচিত। কিন্তু দু’দলের নেতারাই ভবিষ্যতের বদলে অতীত নিয়ে বেশি ভাবছেন। তাই তিক্ততা থেকে যাচ্ছে। মান্নান উদাহরণ দিয়েছেন, রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরেও নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভেবেই আমেরিকা এবং ভিয়েতনাম যদি পারস্পরিক সহযোগিতার বন্ধনে জড়াতে পারে, সিপিএম-কংগ্রেসের দূরত্ব মুছতেই বা কীসের বাধা? মান্নান বলছেন, ‘‘হিটলারের সঙ্গে স্তালিনও প্রথমে অনাক্রমণ চুক্তি করেছিলেন। পরে যখন বুঝলেন বিপদ এসেছে, তখন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। তৃণমূলের সঙ্গে জোট করে আমরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ক্ষমতায় এনেছিলাম ঠিকই। কিন্তু তিনি যখন কংগ্রেসকেই ভেঙে চলেছেন, আমরাও তার পাল্টা কৌশল নেব না কেন?’’
পক্ষান্তরে মানসবাবুদের যুক্তি, বামেদের সমর্থন নিয়ে কেন্দ্রে ইউপিএ-১ সরকার তৈরি হয়েছিল বলে এ রাজ্যে কংগ্রেসের বিশ্বাসযোগ্যতা ধাক্কা খেয়েছিল। রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের সম্পর্কে মমতার ব্যবহৃত ‘তরমুজ’ বিশেষণই মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। যে কারণে নন্দীগ্রামে প্রথম আন্দোলনে নেমেও কংগ্রেস জনমানসে কোনও কল্কে পায়নি। মানসবাবুর কথায়, ‘‘আমি নিজে, আমার পরিবার, আমার এলাকার কংগ্রেস কর্মী এবং সাধারণ মানুষ সিপিএমের হাতে আক্রান্ত হয়েছি। ৩৪ বছরের বিভীষিকা আমাকে নাড়া দিয়েছে। ২০০৪-এ বাম সমর্থনে ইউপিএ সরকার হওয়ার সময়েও প্রতিবাদ করেছি। তবে অনেক কথা তখন বাইরে বলতে পারিনি।’’ এখন বামেদের সঙ্গে ফের সমঝোতার জল্পনা তৈরি হওয়া মাত্রই তিনি বিরুদ্ধ যুক্তি পেশ করতে নেমে পড়েছেন।
প্রদেশ কংগ্রেসের অন্দরে অবশ্য সামান্য হলেও ‘বামপন্থী’র সংখ্যা ভারী! এই অংশের যুক্তি, পঞ্চায়েত ও পুরভোটের হিসাবই বলে দিচ্ছে, বামেদের সঙ্গে কংগ্রেসের ভোট যোগ করলে উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গে বেশ কিছু আসন বিরোধীদের ঝুলিতে আসবে। সোমেন মিত্র, প্রদীপ ভট্টাচার্যের মতো প্রাক্তন প্রদেশ সভাপতিরা পরিস্থিতির প্রয়োজনে বামেদের সঙ্গে নিয়ে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ জোট গড়ে তোলায় অন্যায় কিছু দেখছেন না। তাঁদের যুক্তি, এক দিকে মমতা এবং অন্য দিকে নরেন্দ্র মোদীর বিজেপি-কে রুখতে ধর্মনিরপেক্ষ মঞ্চকে শক্তিশালী করা উচিত। কংগ্রেসের অন্দরে মান্নান, প্রদীপদের মতো অনেকেরই আশঙ্কা, তৃণমূলের সঙ্গে জোট ভাঙার পরে মমতার দল এ রাজ্যে কংগ্রেসকে অনবরত ভেঙেই চলেছে। এর পরেও বিধানসভা ভোটে ফের তৃণমূলের হাতই ধরা হলে রাজ্যে কংগ্রেসের যেটুকু সংগঠন অবশিষ্ট আছে, তা-ও ধরে রাখা মুশকিল হবে!
প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী দীপা দাশমুন্সির জেলায় বামেরাই কংগ্রেসের মূল প্রতিপক্ষ। লোকসভা ভোটে দীপা হেরেছেন সিপিএম প্রার্থীর কাছেই। কিন্তু তাঁর কট্টর তৃণমূল-বিরোধিতার কথা কোনও মহলেই অজানা নয়। স্বয়ং প্রদেশ সভাপতি অধীর চৌধুরী স্পষ্ট মতামত না দিয়েই চোখ-কান খোলা রাখছেন। তাঁর যুক্তি, শেষমেশ জোটের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত তো নেবে হাইকম্যান্ড! যে কথা মাথায় রেখে দলের একাংশ হাইকম্যান্ডের গোচরে বাম-সম্ভাবনার বিষয়টি এনে ফেলতে চাইছেন।
কী ভাবছে হাইকম্যান্ড? এআইসিসি-র তরফে পশ্চিমবঙ্গের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা সি পি জোশী কিন্তু বাম-দরজা একেবারে বন্ধ করে দিচ্ছেন না। আনন্দবাজারের প্রশ্নের জবাবে জোশীর বক্তব্য, ‘‘এখনই এই নিয়ে মত দেওয়ার কিছু নেই। নির্বাচনের সময় এলে তখন সমঝোতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে। এখন নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর দিকেই নজর দিচ্ছি।’’
ঠিক যে কথা বলে রাজ্য কমিটির অন্দরে জল্পনা জিইয়ে রেখে গিয়েছেন সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি!