মোড় থেকে একটা রাস্তা ঈষৎ ডান দিকে বাঁক নিয়েছে। আর একটা রাস্তা সপাটে ঘুরে গিয়েছে বামে।
সিপিএম কোন পথে গেল? বোঝা যাচ্ছে না।
একটা রাস্তায় রয়েছে বাঘ। অন্যটায় অপেক্ষা করছে কামট। অভূতপূর্ব এই সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে সিপিএম এক নিদারুণ দোলাচলে। যেন ইষৎ বিভ্রান্ত, দিশাহারাও।
প্রকাশ কারাটরা আগেই বলেছিলেন, সপাটে বামে ঘুরে যাওয়া রাস্তাটা ধরতে। বাংলার নেতারা চেয়েছিলেন, ইষৎ ডানদিকে বাঁক নেওয়া পথটা বাছতে। অঘোষিত ভাবে হলেও, রাজ্য নেতৃত্বের ইচ্ছাই মর্যাদা পেয়েছিল। কট্টরবাদীরা বলেছিলেন, ডানদিকের রাস্তাটা ‘অধর্মের’ রাস্তা। কুলচ্যুত হতে হবে ও পথে হাঁটলে। বাংলার নেতারা বলেছিলেন, বাম দিকের রাস্তা অতলস্পর্শী খাদে গিয়ে পড়েছে। ও পথ ধরলে মৃত্যু অনিবার্য।
বেঁচে থাকতে, ভেসে থাকতে বাংলার মতই গ্রাহ্য হয়েছিল শেষমেষ। কিন্তু ফল? আশাপ্রদ হল না। শ্যামকেও পেল না সিপিএম, কুল ও গেল। এই কুলচ্যুতি মানতে পারছেন না কুলাধিপতিরা। টিকি ঝাঁকিয়ে শুরু করেছেন মন্থন। কী এল, আর কী গেল, সেই আঁক কষতে শুরু করেছেন। কট্টরবাদের খাতায় লোকসানের অঙ্ক দেখেই তেজ আরও বেড়েছে কুলাধিপতিদের। সেই তেজের গনগনে আঁচে এখন পুড়তে হচ্ছে মাটিতে পড়ে থাকা সূর্যকে।
আসলে সবটাই আবর্তিত পাখির চোখটাকে ঘিরে। সূর্যকান্তদের ছোড়া তির যদি লক্ষ্যভেদ করত, তা হলে এত কথা উঠত না। বাংলার সিপিএমকে কেউ ‘ম্লেচ্ছ’ বলতে পারত না। পাখির চোখে তির বেঁধানো যায়নি। তাই পণ্ডিতরা আবার বসেছেন। কাটাছেঁড়া শুরু করেছেন। এই মহামন্থনে উঠে আসছে কত কথা! নীতির প্রশ্ন আসছে, পার্টি লাইন আসছে, বিশাখাপত্তনম পার্টি কংগ্রেসের কথা আসছে, পলিটব্যুরো আসছে, কেন্দ্রীয় কমিটি আসছে। কিন্তু এত কথার পরেও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যাচ্ছে না কিছুতেই। নীতি-নৈতিকতা, রাজনৈতিক অস্পৃশ্যতা, পার্টি লাইন-সহ সব সত্যকে স্বীকার করেও যখন বাংলার নেতারা জিজ্ঞাসা করছেন, খাদে ঝাপ দেওয়াটাই কি উচিত ছিল? পণ্ডিতরা জবাব হাতড়াচ্ছেন। আত্মহত্যার পথকে জোর গলায় সঠিক পথ আর বলবেনই বা কী করে?
দেশের দুই সুদূর প্রান্তে, দুই ছোট রাজ্যে কোনওক্রমে অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখেছে সিপিএম। সবচেয়ে বড় যে রাজ্য দখলে ছিল, সেই বাংলা এখন হাতছাড়া। তবুও সিপিএম নেতৃত্ব জানেন বাংলার শিরায়-উপশিরায় রক্তকণিকার মতো ছড়িয়ে রয়েছে দলীয় জনভিত্তি। একে ঠেলে ধারে ফেলা যায় না। তাই একদিকে কট্টরবাদীদের খুশি করতে সিপিএম একাধারে বলল, বাংলার নির্বাচনী রণকৌশল সংশোধন করতে হবে। অন্য দিকে, দলের সাধারণ সম্পাদক বাংলার সুরে সুর মিলিয়ে বললেন, ইষৎ ডান দিকের পথটাই ভাল।
গুলিয়ে গেল না? রণকৌশল ভুল ছিল বলে মেনে নেওয়া হল। আবার কংগ্রেসের হাত ধরে লড়াই চলবে বলেও জানানো হল। অভূতপূর্ব দিশাহীনতা সিপিএমে। তবে তার জন্যই হয়তো ঝড়ের মুখে পড়েও রাজধানী থেকে মাথা নত করে কলকাতায় ফিরতে হচ্ছে না সূর্যকান্ত মিশ্রদের।