সংস্কারের অভাবে নিকাশি খালের এখনকার অবস্থা।—নিজস্ব চিত্র
এক সময়ে খালে নৌকা চলত, স্বচ্ছ জলে মাছ ধরতেন গ্রামবাসী। সংস্কারের অভাবে সেই খাল এখন ‘গোবর নদী’তে পরিণত হয়েছে। কোথাও বা কচুরিপানার সারি আষ্টেপৃষ্টে বেঁধে ফেলেছে খালকে। অথচ, এক সময়ে বিস্তীর্ণ এলাকার নিকাশি ব্যবস্থায় প্রধান সহায়ক ছিল এই ডানকুনি খাল। খাল সংস্কার নিয়ে এলাকার মানুষের দাবির মধ্যে যখনই ভোট এসেছে, খাল সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলি। ভোটপর্ব চুকলে কেউ ফিরেও তাকায়নি। ফলে মজা খাল মজাই থেকে গিয়েছে। আর প্রতি বছর বর্ষায় নাকাল হয়েছেন বাসিন্দারা। এ বারও বর্ষায় ফের ডুববে জনপদ, এমন আশঙ্কা নিয়েই দিন কাটছে এলাকাবাসীর।
বহু বছর আগে চাষের জল আর নিকাশির কথা ভেবে সরস্বতী নদী থেকে ডানকুনি খাল নামে এই খাল কাটা হয়েছিল। জনাই, পাঁচঘড়া, বেগমপুর, ডানকুনি, বন্দের বিল হয়ে বালিখালে গঙ্গার সঙ্গে মিশেছে এই খাল। প্রথম দিকে খুবই কাজের হয়েছিল খালটি। খালের দু’ধারে প্রচুর চাষাবাদ হত। ক্রমে কমতে থাকে চাষবাস। তার বদলে একের পর এক কল-কারখানা গড়ে ওঠে। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে আর দিল্লি রোডের ধারে গড়ে ওঠে ডানকুনি শিল্পাঞ্চল। ধীরে ধীরে শিল্পাঞ্চলের বহু কারখানা তাদের বর্জ্য পদার্থ নিকাশির জন্য বেছে নেয় ডানকুনি খালকেই। দিনের পর দিন কারখানার বর্জ্যে পচে যায় খালের জল। সংস্কারের অভাবে পলি জমে গিয়ে প্রবাহ হারায় খাল। কিন্তু খালের এমন অবস্থাতেও চোখ বুজে থেকেছে প্রশাসন।
শুধু এটাই নয়। বাম জমানায় কলকাতা থেকে খাটাল উচ্ছেদ হল। তার ফলও ভুগতে হল ডানকুনিকেই। প্রায় দেড়শো খাটাল সেই সময়ে উঠে আসে ডানকুনি খালের দু’ধারে। গোখাদ্য থেকে শুরু করে খাটালের যাবতীয় বর্জ্য পড়তে শুরু করল খালে। দিনের পর দিন গোবর জমে খালের অস্তিত্বই কার্যত হারিয়ে গিয়েছে। স্থানীয় মানুষের কথায়, খাল এখন গোবরের নদী। মশা, মাছি আর দুর্গন্ধের আঁতুরঘর। স্থানীয় মানুষের অভিযোগ, বছরের পর বছর ধরে স্রেফ শাসক দলের নেতাদের ম্যানেজ করেই খাটাল-মালিকদের বাড়বাড়ন্ত।
কংগ্রেস নেতা আলি আফজল চাঁদ খালটির সংস্কারের দাবিতে এক সময়ে আন্দোলন করেছেন। প্রশাসনের নানা মহলে স্মারকলিপি দিয়েছেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। উল্টে ফি-বছর বৃষ্টিতে ভেসেছে এলাকা। সংস্কার না হওয়ায় ভেঙে পড়েছে নিকাশি ব্যবস্থা। পাঁচঘড়া, জনাই, ডানকুনি, ডানকুনি হাউজিং, রঘুনাথপুর, নৈটি, মনোহরপুর প্রভৃতি এলাকার বাসিন্দাদের বক্তব্য, এ বার বর্ষাতেও নিস্তার মিলবে না তাঁদের। কেননা, পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, সেচ দফতর, পুরসভাকেউই উদ্যোগী হয়নি খাল সংস্কারে। দূষণ রোধেও কোনও কাজ হয়নি।
আফজল চাঁদ বলেন, “বছর দশেক আগে চণ্ডীতলা-২ পঞ্চায়েত সমিতি কিছুটা অংশে পানা তোলার কাজ করেছিল। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা নগণ্য। খালের জল এতটাই দূষিত যে হাত দিলে চর্মরোগ অবধারিত। কিন্তু সে দিকেও কারও নজর নেই।”
জেলা পরিষদের সেচ কর্মাধ্যক্ষ মানস মজুমদার বলেন, “ডানকুনি খাল সংস্কারে ৩০ কোটি টাকার প্রকল্প পাঠানো আছে। অন্যান্য সমস্যাও মিটে গিয়েছে। টাকা বরাদ্দ হলেই কাজ শুরু হয়ে যাবে।” একই কথা জানিয়েছেন জেলা সেচ ও জলপথ দফতরের আধিকারিক ভাস্বর সূর্যমণ্ডল।
ডানকুনি খাল নিয়ে যে সমস্যা রয়েছে তা স্বীকার করেছেন পুরপ্রধান হাসিনা শবনমও। তিনি বলেন, “এলাকায় অন্যান্য উন্নয়নের পাশাপাশি এই খালেরও সংস্কার করা হবে। ভোট মিটে গেলে সেই কাজ শুরু হবে।
২০০৯ সালে ডানকুনি পুরসভা গঠিত হয়। ক্ষমতা দখল করে কংগ্রেস-তৃণমূল জোট। ভোটের প্রচারে ডানকুনি খালের এই দূরবস্থার জন্য সিপিএমের অপদার্থতার দিকেই আঙুল তুলেছিল তারা। ক্ষমতায় এলে খাল সংস্কারের প্রতিশ্রুতিও দিয়েছিল। পুরবাসীর অভিযোগ, ক্ষমতা দখলের পরে চার বছর কেটে গেলেও তা নিয়ে আর কোনও উচ্চবাচ্য করেনি কংগ্রেস-তৃণমূল জোটের পুরবোর্ড। তাঁদের আরও অভিযোগ, বহু জায়গাতেই খাল সংকীর্ণ হয়ে এসেছে। দু’পাড় দখল হয়ে গিয়েছে। গোবরা, ডানকুনি, মনোহরপুর জুড়ে খালের দু’ধারে বিস্তৃত খাটাল। গরু-মোষের স্নানও খালের জলেই।
যথারীতি এ বারের লোকসভার ভোটেও খাল সংস্কারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ময়দানে নেমে পড়েছিল রাজনৈতিক দলগুলি। কিন্তু ভুক্তভোগী মানুষের মনে সেই প্রতিশ্রুতি নতুন করে ভরসা জাগাতে পারেনি। তাঁরা ইতিমধ্যেই বলতে শুরু করেছেন খাল সংস্কার কারওই মাথাব্যাথা নেই। আসলে সবই মুদ্রার এ পিঠ ওপিঠ।