ট্রেন ধরতে হন্তদন্ত হয়ে প্ল্যাটফর্মে ঢুকলেন এক যুবক। বনগাঁ লোকাল সবে হেলেদুলে প্ল্যাটফর্ম ছাড়ছে।
যুবকটি দৌড়ে ট্রেন ধরতে যাবেন, পাশ থেকে খপাৎ। হাত ধরে হাসি-হাসি মুখে এক প্রৌঢ় বলে উঠলেন, “এত তাড়া কীসের ভাই, পরের ট্রেনে যাবেন। চলন্ত ট্রেনে এ ভাবে উঠবেন না।” তিরিক্ষি মেজাজে জবাব দিতে যাচ্ছিলেন যুবকটি। ঠোঁটের ডগায় প্রশ্ন ঝুলে রইল আশপাশের ভিড়টা দেখে। জনতাই বলে দিল “কিছু মনে কোরো না ভাই। উনি আমাদের বনগাঁর বিজেপি প্রার্থী কেডি বিশ্বাস। প্রচারে বেরিয়েছেন।” কেডি বললেন, “দয়া করে আমায় ভোটটা দেবেন। আর, দেখেশুনে চলাফেরা করবেন।”
শুক্রবার সকাল ৬টা থেকে সাদা পাজামা-পাঞ্জাবিতে ধোপদুরস্ত হয়ে উত্তর ২৪ পরগনার বনগাঁ স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকেই ভোটপ্রচার শুরু করলেন কৃষ্ণদাস বিশ্বাস ওরফে কেডি। সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘের সঙ্ঘাধিপতি তথা বড়মার (বীণাপানি দেবী) বড়ছেলে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুরকে ওই কেন্দ্রে দাঁড় করিয়েছে তৃণমূল। সঙ্ঘের প্রাক্তন সাধারণ সম্পাদক কেডি-কে পদ্মফুল চিহ্নে দাঁড় করিয়ে পাল্টা চমক দিয়েছে বিজেপিও। প্রচার শুরুও হল চমক দিয়েই।
শুধু প্ল্যাটফর্মে নয়, আপ-ডাউন বনগাঁ লোকালে এগিয়ে-পিছিয়ে নিত্যযাত্রীদের মধ্যে প্রচার সারলেন অসামরিক প্রতিরক্ষা দফতরের অবসরপ্রাপ্ত আধিকারিক কেডি। এলাকায় তিনি নতুন মুখ নন। বাড়ি বনগাঁর ঠাকুরপল্লিতে। আগেও বনগাঁ লোকালে যাতায়াত করেছেন। পরিচিতেরা অনেকেই এগিয়ে এসে করমর্দন করে গেলেন। অপরিচিতদের দিকে তিনি নিজেই এগিয়ে গেলেন হাসিমুখে। কথা বললেন প্ল্যাটফর্মে বসে থাকা জুতো পালিশওয়ালার সঙ্গেও। প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে দফায়-দফায় চায়ের ভাঁড় আর লেড়ো বিস্কুট হাতে টুকটাক আলাপও সারলেন।
ট্রেনে চেপে একেবারে পাকা হকারদের মতোই লাফিয়ে স্টেশনে নেমে বারবার কামরা পাল্টালেন প্রবীণ মতুয়া। মহিলা কামরায় ওঠার আগে একটু ইতস্তত করছিলেন। কামরার ভিতর থেকেই এগিয়ে এল কিছু হাত। উঠেই সিটে বসে থাকা এক বৃদ্ধার পা ছুঁয়ে প্রণাম সেরে নিজের পরিচয় দিলেন কেডি। ভোটও চাইলেন। অনেকেই দু’হাত তুলে শুভেচ্ছা জানালেন। কেউ-কেউ বললেন, “আপনিই জিতবেন, নিশ্চিন্ত থাকুন।” বনগাঁর শক্তিগড়ের বাসিন্দা কৃষ্ণেন্দু পালিত বললেন, “ষোলো বছর লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করছি। এই প্রথম এমন প্রচার দেখলাম।”
কামরা পাল্টে-পাল্টে এই ভাবেই কেডি গেলেন মছলন্দপুর। এর মধ্যে গোবরডাঙা স্টেশনে নেমে দেখেন, মোদী-মুখোশ পড়ে ১ টাকার ‘নমো-চা’ বিক্রি করছেন এক যুবক। তাঁকে ডেকে গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। মতুয়া ভোট পাবেন? যাত্রীদের মধ্যে থেকে উড়ে যআসা প্রশ্নে কেডি-র জবাব, “প্রায় ৫০ শতাংশ মতুয়া ভোট পাওয়ার ব্যাপারে আমি নিশ্চিত।” ঠাকুরনগর স্টেশন থেকে উঠলেন কিছু যাত্রী। এখানেই মতুয়াদের পীঠস্থান ঠাকুরবাড়ি। তাঁরা চিনতে পারলেন কেডি-কে। হঠাৎ সেই ভিড়টা ধ্বনি তুলল, “কেডি বিশ্বাস জিন্দাবাদ।” আচমকা হইহইয়ে কেডি-ই অপ্রস্তুত!
প্রচার সেরে উল্টো মুখের ট্রেন ধরে বেলা সাড়ে ১১টা নাগাদ প্রার্থী ফিরলেন বনগাঁয়। হঠাৎ লোকাল ট্রেনকে বেছে নিলেন কেন প্রচারের জন্য? কেডি-র ব্যাখ্যা, “নিত্যযাত্রীদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ কম। বাড়িতে গেলেও হয়তো অনেকের সঙ্গে দেখা হবে না। তাঁরা ভোরে বেরিয়ে যান, ফেরেন রাতে। তা ছাড়া, আমি অনেক দিন লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করেছি। নিত্যযাত্রীদের সমস্যার কথা জানি।”
দিল্লির ট্রেন ধরতে পারবেন কি না, কেডি জানেন না। তবে বনগাঁ লোকালে থেকে-থেকে একটাই স্লোগান “দিল্লিতে মোদী, বনগাঁয় কেডি!”