ধান আমাদের প্রধান ফসল। কম-বেশি ৪২ লক্ষ হেক্টর আমন ধান চাষের উপর দাঁড়িয়ে গ্রামবাংলার অর্থনীতি, খাদ্য সুরক্ষার নিশ্চয়তা। বিঘা প্রতি ধানের উৎপাদন বাড়িয়ে চাষ লাভজনক না করতে পারলে অর্থনীতির এই স্তম্ভকে সুদৃঢ় করা যাবে না। সেই লক্ষ্যে সংকর ধান চাষ হল সময়ের দাবি মেনে এক উপযুক্ত কৃষি পরিকল্পনা। প্রতিবেশী দেশ চিনে সিংহভাগই সংকর ধানের চাষ। আমাদের দেশের পঞ্জাব, হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ে সংকর ধানের চাষ ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। সরকারও চাইছে কমপক্ষে ২৫ শতাংশ ধান চাষ সংকর জাতের অাওতায় আনতে।
সংকর ধান কী
দু’টি পৃথক পুরুষ ও স্ত্রী ধান গাছের ইতর পরাগ মিলন ঘটিয়ে বা সংকরায়ণ ঘটিয়ে প্রথম প্রজন্মের যে বীজ উৎপাদন হয়, তাকেই সংকর ধানবীজ বলে। যার ফলন ও গুণমান বাবা-মায়ের গড় ফলন ও গুণমানের তুলনায় বেশি হয়। এই বীজ একবারই চাষ করা যায় অর্থাৎ উৎপাদিত ধান পরের চাষে ব্যবহার করা যাবে না।
উপকারিতা
বিঘা প্রতি এক থেকে দেড় কুইন্টাল বাড়তি উৎপাদন।
বিঘা প্রতি বীজ ও সারজনিত ৬০০-৭০০ টাকা খরচ ধরে বাড়তি ১০০০-১২০০ টাকা লাভ হয়।
খরা সহনশীল, রোগ পোকা কম।
মেয়াদ কম, রবি চাষে পূর্ণ সুযোগ।
বীজতলার আকার
এক বিঘা জমির জন্য ২ কাঠা বীজতলা প্রয়োজন। এক মিটার চওড়া ও সুবিধামতো লম্বা বীজতলায় বিভিন্ন খণ্ডের মধ্যে ৮-১০ ইঞ্চি চওড়া ও ৪ ইঞ্চি গভীর নালা রাখতে হবে।
চারা তৈরি
জুলাই মাস হল সেরা সময়। অগস্টের প্রথম সপ্তাহের মধ্যে রুইলে রবি ফসলের জন্য যথেষ্ট সুযোগ পাওয়া যায়। রোয়ার ৩-৪ সপ্তাহ আগে বীজ বুনতে হবে। মৌসুমী বৃষ্টির সুযোগ নিয়ে ভাল ভাবে চাষ দিয়ে ও গোবর সার মিশিয়ে কাদানো বীজতলা তৈরি করতে হবে। মূল সার হিসাবে ২ কাঠা জমিতে ৩ কেজি এন পি কে ১০:২৬:২৬ সার দিতে হবে। সংকর ধানের বীজ পরিষ্কার জলে ২৪ ঘণ্টা ভিজিয়ে ও তার পর জল থেকে ছেঁকে শুকিয়ে নিন। এরপর প্রতি কেজি বীজের সঙ্গে ২ গ্রাম কার্বেন্ডাজিম ৫০ শতাংশ বা ১ গ্রাম ট্রাইসাইক্লাজোল ৭৫ শতাংশ গুঁড়ো মিশিয়ে শোধন করার পর ভেজানো চটে জাঁক দিয়ে কল বার করে কাদানো বীজতলায় বপন করতে হবে। বপনের ৪ ঘণ্টা পর ছিপছিপে জল রাখতে হবে। বর্গমিটার প্রতি ২০-২৫ গ্রাম বীজ ছড়াতে হবে। চারা তোলার ৭ দিন আগে বীজতলায় জল না রেখে ২ কাঠা প্রতি এক কেজি ইউরিয়া প্রয়োগ করে ৪৮ ঘণ্টার পর জল দিলে পাশকাঠি ছাড়তে সুবিধা হয়।
মূল জমি ও সার
নিকাশি ব্যবস্থা আছে ও জলসেচের সুযোগ আছে এমন উঁচু বা মাঝারি উঁচু জমি সংকর ধান চাষের উপযোগী। উচ্চ ফলনশীল ধান চাষের মতো পচান দিয়ে এমন ভাবে মূল জমি তৈরি করতে হবে যাতে কাদা ৪-৫ ইঞ্চি গভীর হয়। কাদা করার প্রথম ধাপে পর্যাপ্ত জৈব সারের সঙ্গে ৮০-১০০ মিলি ফসফেট ঘটিত জীবাণু সার প্রয়োগ করলে মাটির স্বাস্থ্য সমৃদ্ধ হয়। মাটির উর্বরতা স্বাভাবিক থাকলে বিঘা প্রতি ১০:৫:৫ হারে নাইট্রোজেন, ফসফেট ও পটাশ প্রয়োগ করতে হবে। শেষ চাষের আগে সারের পরিমাণ থাকবে এই রকম— এন পি কে ১০:২৬:২৬ ১৯ কেজি+ইউরিয়া ১ কেজি বা ডিএপি ১১ কেজি+এমওপি ৮ কেজি+ইউরিয়া ১ কেজি বা এসএসপি ৩১ কেজি+এমওপি ৮ কেজি + ইউরিয়া ৫ কেজি ও অণুখাদ্যের মধ্যে ২ কেজি জিঙ্ক (৩৩ শতাংশ) ও এক কেজি বোরন (১৪.৬ শতাংশ) দিতে হবে।
রোপণ ও পরিচর্যা
২৫-৩০ দিনের পাশকাঠি যুক্ত চারায় ৪-৫টি পাতা থাকবে এবং গুছিতে ১-২টি চারা। চারা ৬ ইঞ্চি X ৬ ইঞ্চি দূরে ১ ইঞ্চি গভীরতায় রুইতে হবে। রোয়া পূর্ব-পশ্চিমে হলে গাছ সূর্যালোক বেশি পাবে। প্রতি বর্গমিটার জমিতে ৪২-৪৪টি গুছি থাকবে এবং শুকনো চারাগাছ থাকলে রোপণের ১০ দিনের মধ্যে ফাঁক পূরণ করে দিতে হবে। রোয়ার ৩-৪ দিনের মধ্যে আগাছানাশক প্রেটিলাক্লোর ৫০ শতাংশ ২ মিলি বা বুটাক্লোর ৫০ শতাংশ ৬ মিলি প্রতি লিটার জলে গুলে বিঘা প্রতি ৭০ লিটার স্প্রে করতে হবে। রোয়ার ২০ দিনের মাথায় ১০ কেজি ইউরিয়া ও থোড় আসার মুখে আরও ৫ কেজি ইউরিয়া চাপান সার দিতে হবে। শীষমুকুল সূচনার আগে ও ফুল আসার পরে এক শতাংশ হারে জলে দ্রবণীয় এন পি কে ১৮:১৮:১৮ স্প্রে করলে ফসলের লুকনো খিদে মেটে ও দানা পুষ্ট হয়। রোপণের ২ দিন পর থেকে ২৫ দিন পর্যন্ত ছিপছিপে জল, ২৬-৩৩ দিন পর্যন্ত দেড় থেকে ২ ইঞ্চি জল থাকবে। পরের ৪-৫ দিন জল বন্ধ করে পাশকাঠি জন্মানো রোধ করতে হবে। শীষমুকুলের সূচনা থেকে শীষ বের হওয়া পর্যন্ত সোয়া ইঞ্চি জল থাকবে। দানা পুষ্ট হওয়ার দ্বিতীয় দফায় জলের অভাব হলে বীজ চিটে হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই এই সময় জলসেচ চালিয়ে যেতে হবে। ধান কাটার ১০ দিন আগে জল বন্ধ রাখতে হবে।
লেখক: ইফকো-র মুখ্য আঞ্চলিক অধিকর্তা।