নোটের চোট

কপিল মুনির মন্দিরে প্রণামী বাক্সেও টান

‘বাবাকে লিয়ে ইসবার সিরফ্ ইতনাহি’— কপিল মুনির আশ্রম থেকে বেরনোর মুখে প্রণামী বাক্সের পাশে একখানা নারকেল রেখে কপালে দু’বার হাত ঠেকিয়ে বললেন রাজেন্দ্র ওঝা। মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা রাজেন্দ্র চাষবাস করেন। সারা বছর অল্প অল্প করে টাকা জমান পুণ্যস্নানে আসবেন বলে। দেহাতি হিন্দিতে যা বললেন, তার অর্থ, এ বার হাতে টাকার বড় টান। কোনও মতে যাতায়াত ভাড়াটুকু আছে।

Advertisement

তানিয়া বন্দ্যোপাধ্যায়

গঙ্গাসাগর শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:৫৫
Share:

দলে দলে। শুক্রবার গঙ্গাসাগর মেলায় শৌভিক দে-র তোলা ছবি।

‘বাবাকে লিয়ে ইসবার সিরফ্ ইতনাহি’— কপিল মুনির আশ্রম থেকে বেরনোর মুখে প্রণামী বাক্সের পাশে একখানা নারকেল রেখে কপালে দু’বার হাত ঠেকিয়ে বললেন রাজেন্দ্র ওঝা।

Advertisement

মধ্যপ্রদেশের বাসিন্দা রাজেন্দ্র চাষবাস করেন। সারা বছর অল্প অল্প করে টাকা জমান পুণ্যস্নানে আসবেন বলে। দেহাতি হিন্দিতে যা বললেন, তার অর্থ, এ বার হাতে টাকার বড় টান। কোনও মতে যাতায়াত ভাড়াটুকু আছে। তা-ই বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে চলছেন। দেশের বাড়ি থেকে আসার সময়ে দু’টো নারকেল এনেছিলেন। শুক্রবার একটা চড়িয়েছেন বাবার মন্দিরে। অন্যটা শনিবার ভোরে পুণ্যস্নান সেরে দেবেন বলে হাতে রেখেছেন। রাজেন্দ্রর কথায়, ‘‘হাম গরিবো কে হাথ আভি পয়সা কাঁহা, বাবাকে লিয়ে ইসবার সিরফ্ নারিয়েল!’’

মন্দিরের সামনে খানিক দাঁড়িয়ে দেখা গেল, বাস্তবিকই প্রণামীর বাক্সের সামনে স্তূপাকার হয়ে আছে নারকেল, কলা, আপেল, পেয়ারা। নারকেলের সংখ্যাই বেশি। ভারতের নানা প্রান্ত থেকে আসা ভক্তেরা অনেকেই নগদ টাকার বদলে ফল প্রণামী দিচ্ছেন। মন্দিরের এক আধিকারিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, অন্যবারও ফল দিয়ে প্রণামী দেওয়ার রেওয়াজ ছিল। কিন্তু এ বার ফলের সংখ্যাটা বেড়েছে কয়েক গুণ। তিনি জানালেন, অন্যবার পুণ্যস্নানের কয়েক দিন আগে থেকেই টাকা রাখার ঝুড়িটা ঘন ঘন উপচে পড়ত। খুচরোও জমত প্রচুর। দশ মিনিট ছাড়া ছাড়া ঝাঁট দিয়ে সরিয়ে ফেলা হতো পয়সা। কিন্তু এ বার ঈশ্বরের থানেও টাকার টান।

Advertisement

‘‘সব নোট-বন্দিকা খেল’’— বলতে বলতে পাশ দিয়ে চলে গেলেন এক প্রবীণ ভক্ত।

নোটের চোটে কাবু সাগরমেলা। প্রশাসনের আশা ছিল, কুম্ভমেলা না থাকায় এ বারে সাগরে ভিড় হবে আরও বেশি। সেই মতো প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু কোথায় কী! প্রশাসনের একটি সূত্র জানাচ্ছে, মকরসংক্রান্তির আগের দিন, শুক্রবার মাত্র আড়াই লক্ষ পুণ্যার্থী এসেছেন। অন্য বছর এই দিনে সংখ্যাটা থাকে প্রায় দ্বিগুণ। নোট-কাণ্ডে দেশে যে অচলাবস্থা চলছে, তার প্রভাবেই এ বার গঙ্গাসাগরের ময়দান ফাঁকা বলে মনে করছেন তাঁরা। পঞ্চায়েত মন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ও বলেন, ‘‘উত্তরপ্রদেশ এবং বিহারের বড় অংশ আসতে পারলেন না। খুচরোর আকালে অনেকের সমস্যা হচ্ছে।’’

ভিড় কম হওয়ায় দুশ্চিন্তায় ব্যবসায়ীরা। নদিয়া থেকে গামছা বিক্রি করতে এসেছেন রতন দাস। বললেন, ‘‘আসতেই খরচ প্রায় ন’শো টাকা। অথচ এখনও ৯ টাকার মালও বেচতে পারিনি!’’ সাগরের বাসিন্দা গিয়াসুদ্দিন কাজি ব্যাগের পসরা নিয়ে বসেছেন। তাঁর অন্য অভিজ্ঞতা। বললেন, ‘‘৫০ টাকার ব্যাগ কিনতে অনেকে ২০০০ টাকার নোট ধরাচ্ছেন। কোথা থেকে দেবো এত খুচরো? অনেককে ফিরিয়ে দিতে হচ্ছে।’’

মেলায় একটি এটিএম। প্রশাসনের এক কর্তা বলেন, ‘‘একাধিক এটিএম বসানোর মতো পরিকাঠামো নেই। তাই মানুষের অসুবিধা হচ্ছে জেনেও কিছু করার নেই।’’

কিন্তু মোদীর সাধের ‘ডিজিটাল ইন্ডিয়া’ কত দূর এগলো? ‘‘ধুস, কোথায় কী’’— বললেন মুর্শিদাবাদের অসীম দত্ত। তাঁর কথায়, ‘‘হাতে নগদ টাকা বিশেষ নেই। ভেবেছিলাম এখানে কার্ড দিয়ে কাজ চালাব। কিন্তু তেমন কোনও পরিকাঠামো তো চোখে পড়ছে না! বড্ড মুশকিলে পড়লাম।’’

কপিল মুনির প্রণামীর ঝুড়ি হোক বা গামছাওয়ালা রতন দাসের ক্যাস বাক্স— নোটের চোটে প্রভাব পড়েছে সর্বত্রই। এক প্রবীণ পুণ্যার্থী বলেই ফেললেন, ‘‘ইহকাল-পরকাল সবই ঝরঝরে হয়ে গেল নোটের চোটে!’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন