‘ক্লাব ফুট’-এর চিকিৎসা ঠোক্কর খাচ্ছে কুসংস্কারে

সম্প্রতি এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অস্থি বিভাগে ‘ক্লাব ফুট’-এর চিকিৎসা-পদ্ধতি নিয়ে এক আলোচনাসভা ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছিল।

Advertisement

সৌরভ দত্ত

কলকাতা শেষ আপডেট: ১২ জুলাই ২০১৯ ০৩:১১
Share:

রোগের চিকিৎসা রয়েছে। তবুও ‘ক্লাব ফুট’ বা ‘চক্রপদে’ আক্রান্ত শিশুদের প্রতিবন্ধকতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে পরিবারের কুসংস্কার। রাজ্য সরকারের সঙ্গে চুক্তির ভিত্তিতে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলিতে ‘ক্লাব ফুট’-এর চিকিৎসার বিশেষ ক্লিনিক পরিচালনা করে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। সেই ক্লিনিকের সঙ্গে যুক্ত স্বাস্থ্যকর্মীদের অভিজ্ঞতাই বলছে, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের যুগেও কুসংস্কারের জালে আটকে রয়েছে স্বাস্থ্য পরিষেবা!

Advertisement

সম্প্রতি এন আর এস মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের অস্থি বিভাগে ‘ক্লাব ফুট’-এর চিকিৎসা-পদ্ধতি নিয়ে এক আলোচনাসভা ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করা হয়েছিল। কুসংস্কার পেরিয়ে শিশুদের সরকারি হাসপাতালে আনতে গেলে কেমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয়, সভায় তা জানান স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার প্রতিনিধিরা।

এন আর এসের অস্থি বিভাগের বিশেষ ক্লিনিকে চিকিৎসার জন্য মেয়েকে নিয়ে আসতেন ঝড়খালির এক বধূ। তিন সপ্তাহ পরে আচমকাই হাসপাতালে আসা বন্ধ করে দেন তিনি। কেন ওই মহিলা আসছেন না, তা জানতে তাঁর বাড়ি গিয়ে দুর্ব্যবহারের মুখে পড়েন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার এক প্রতিনিধি। তাঁর কথায়, ‘‘মেয়ের চিকিৎসা চালিয়ে যেতে চান মা। কিন্তু বাড়ির লোকের বক্তব্য, গর্ভবতী অবস্থায় সূর্যগ্রহণের সময়ে বারণ করা সত্ত্বেও তিনি ঘর থেকে বেরিয়েছিলেন। সন্তানের পায়ের বিকৃতি নাকি সে জন্যই!’’

Advertisement

এ কথা শুনেও হাল ছাড়েননি ওই প্রতিনিধি। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করলে পায়ের বিকৃতি পুরোপুরি সেরে যাবে, তা বারবার বোঝানোর চেষ্টা করেন তিনি। তখন পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদের বক্তব্য ছিল, ‘‘মেয়েমানুষের বাঁকা পায়ের চিকিৎসার দরকার নেই। ও আমরা বিয়ে দিয়ে দেব। ঘরেই তো থাকবে!’’ চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, দেড় বছরের ওই শিশুর চিকিৎসা শুরু হলে এখনও সুস্থ হওয়া সম্ভব।

এন আর এসের অস্থি বিভাগের চিকিৎসক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় জানান, পায়ের পাতার জন্মগত বিকৃতিকে ‘ক্লাব ফুট’ বা ‘চক্রপদ’ বলে। কোনও শিশুর একটি পা, কারও দু’টি পায়ে এমন বিকৃতি দেখা যায়। এই রোগের ক্ষেত্রে বড় অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন নেই। ওষুধও কিছু নেই। চিকিৎসকদের মতে, জন্মের পরে পরিস্থিতি বিচার করে বিকৃত পায়ের কাস্টিং বা প্লাস্টার করতে হয়। আট সপ্তাহ এ ভাবে চিকিৎসা চলার পরে আক্রান্তদের বিশেষ ধরনের জুতো পরতে দেন চিকিৎসকেরা। তাঁদের মতে, এই রোগের কারণ সম্পর্কে এখনও পর্যন্ত স্পষ্ট ব্যাখ্যা মেলেনি। কিছু ক্ষেত্রে জিনঘটিত কারণে এই রোগ হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে।

কিন্তু ঝড়খালি, হাসনাবাদ, ধনেখালির পরিবারগুলি এই যুক্তি মানতে নারাজ। ধনেখালির নানিকুলের বাসিন্দা একটি পরিবার কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ছেলের বিকৃত পায়ের চিকিৎসা করাচ্ছিল। মাঝপথে কেন চিকিৎসা বন্ধ করলেন, তা জানতে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কাউন্সেলর রোগীর বাড়ি গেলে পরিবারের বয়স্ক মহিলারা বলেন, ‘‘গর্ভবতী অবস্থায় রাজ্য সরকার যে আয়রন বড়ি দিয়েছিল, তার জন্য এ সব হয়েছে। আমরা ওই বড়ি খাইনি। কই, আমাদের ছেলের তো কিছু হয়নি!’’

হাসনাবাদের ঘটনায় আবার এক দম্পতির যমজ সন্তানের মধ্যে এক জনের ‘ক্লাব ফুট’ হয়েছিল। এক ছেলেকে বাড়িতে রেখে আক্রান্ত সন্তানকে সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যেতেন মা। সেই দোষে স্বামী তাঁকে তাড়িয়ে দেন বলে অভিযোগ।

স্বেচ্ছাসেবী সংস্থাটির তরফে চিকিৎসক সন্তোষ জর্জ বলেন, ‘‘পশ্চিমবঙ্গে ১০ হাজার বাচ্চার এই মুহূর্তে ‘ক্লাব ফুট’-এর চিকিৎসা চলছে। সারা দেশের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ৬০ হাজার।’’ অস্থি চিকিৎসক উৎপলবাবু বলেন, ‘‘এক দিন হাসপাতালে আসা মানে সে দিনের রোজগার নষ্ট হওয়া। অনেকের ক্ষেত্রে এই ভাবনাও কাজ করে। কিন্তু সব বাধা টপকে আক্রান্ত শিশুদের পরিষেবা দিতে আমরা বদ্ধপরিকর।’’ এন আর এসের অনুষ্ঠানে হাজির স্বাস্থ্য দফতরের যুগ্ম অধিকর্তা তথা চিকিৎসক অসীম দাস মালাকার বলেন, ‘‘প্রতি দশ হাজার বাচ্চার মধ্যে এক জনের ক্লাব ফুট হয়। এই রোগের চিকিৎসা যে রয়েছে, সে বিষয়ে আমজনতাকে সচেতন করা জরুরি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন