ছেলের সঙ্গে আকাশ আগরওয়াল। বুধবার। —নিজস্ব চিত্র।
মৃত্যুকে কার্যত খুব কাছ থেকে দেখেছেন ওঁরা! প্রাণে বাঁচলেও তাই দুঃস্বপ্নের মতো আতঙ্ক গ্রাস করেছে অগ্নিকাণ্ডের সময়ে হোটেলে থাকা অতিথিদের। তাঁরা কেউ জানলা থেকে কোনও মতে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন। কেউ আবার দীর্ঘ অপেক্ষার পরে নেমেছেন পুলিশ এবং দমকলকর্মীদের সাহায্যে। এক কাপড়ে আশপাশের হোটেলে আপাতত আশ্রয় নিলেও মঙ্গলবার রাতের কথা বলতে গিয়ে কেঁপে উঠছেন তাঁরা।
মঙ্গলবার জোড়াসাঁকো থানা সংলগ্ন হোটেলের আগুনে ১৪ জন অতিথির মৃত্যু হয়েছে। কলকাতা পুলিশের বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনী এবং দমকলকর্মীরা উদ্ধার করেন ৯৯ জনকে। তাঁদের অধিকাংশ আপাতত আশপাশের হোটেলে আশ্রয় নিয়েছেন।
ইডেনে খেলা দেখতে এসে ২৬ তারিখ এই হোটেলে উঠেছিল ওড়িশার একটি পরিবার। মঙ্গলবার রাতেই তাদের ফেরার কথা ছিল। বেরোনোর আগেই আগুন লেগে যায়। বুধবার সকালে হোটেলের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন পরিবারের সকলে। আকাশ আগরওয়াল নামে এক জন জানান, স্ত্রী, ছেলে-সহ মোট ছ’জন রয়েছেন তাঁরা। রাত ৯টা নাগাদ তাঁদের বেরোনোর কথা ছিল। ব্যাগ গুছিয়ে রাতের খাবার কিনতে বাইরে গিয়েছিলেন আকাশ। ফিরে এসে দেখেন, হোটেলের সামনে সকলে ছোটাছুটি করছেন। তিনি বলেন, ‘‘খাবার কিনে আমি আর ছেলে যখন ফিরি, তখন দেখি, সবাই ছোটাছুটি করছেন। স্ত্রী-সহ বাকিরা সবাই হোটেলের ঘরে আটকে ছিল।’’ তাঁর স্ত্রী নেহা জানান, ঘণ্টা দুই পরে কার্নিস থেকে তাঁদের মই দিয়ে নীচে নামানো হয়েছিল। তাঁর কথায়, ‘‘ওই দু’ঘণ্টা সময় কী ভাবে কেটেছে, বোঝাতে পারব না। আগুন লেগেছে বুঝতে পেরে আমরা সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু নামার কোনও উপায় ছিল না। চার দিকে ধোঁয়া থাকায় কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। আমাদের মতো অনেকেই ছোটাছুটি করছিলেন। শেষে সিঁড়ি দিয়ে ছাদের দিকে উঠতে থাকি। এক সময়ে ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নিতে পারছিলাম না। ছাদে যেতে না পেরে আমরা কার্নিসেই দাঁড়িয়ে ছিলাম ওই দু’ঘণ্টা।’’ এক নিঃশ্বাসে কথা বলতে গিয়ে বার বার রুমাল দিয়ে মুখ মুছছিলেন নেহা। মাকে আঁকড়ে জড়িয়ে থাকা বছর ছয়-সাতের ছেলের চোখেও ছিল আতঙ্ক।
এই হোটেল থেকে প্রাণ বাঁচিয়ে কেউ মহাত্মা গান্ধী রোডের হোটেলে পরিবার নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, কেউ ওই রাতেই উঠেছেন রবীন্দ্র সরণি সংলগ্ন হোটেলে। ওই রাতের কথা বলতে গিয়ে বার বার আঁতকে উঠছেন তাঁরা। নিজেদের অভিজ্ঞতাই যেন তাঁরা এখনও বিশ্বাস করতে পারছেন না। শুধু অতিথিরা নন, মৃত্যু-মুখ থেকে ফিরেছেন হোটেলের অধিকাংশ কর্মীও। হোটেলের জানলা ভেঙে ঝাঁপ দিয়ে কোনও মতে প্রাণ বাঁচিয়েছেন তাঁদেরই এক জন, সঞ্জয় দাস। এ দিন ফোনে সঞ্জয় জানালেন, চার বছর ধরে ওই হোটেলে কাজ করছেন। অগ্নিকাণ্ডের সময়ে পাঁচতলায় ছিলেন। তাঁর কথায়, ‘‘আগুন লেগেছে বুঝতে পেরে অতিথিদের চিৎকার করে বেরিয়ে আসতে বলছিলাম। সকলে যে যাঁর মতো দৌড়োদৌড়ি করছিলেন সেই সময়ে। আমিও দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় নেমে আসি। বেশ কিছু সময় সেখানেই কাটে। পরে কোনও উপায় না দেখে দোতলার জানলার কাচ ভেঙে সেখান থেকে ঝাঁপ দিই।’’ পায়ে এবং হাতে আঘাত লেগেছে তাঁর।
মঙ্গলবার দুপুরে ওই হোটেলে ঘরের খোঁজে গিয়েও রবীন্দ্র সরণির আর একটি হোটেলে চলে গিয়েছিলেন হরিয়ানার ব্যবসায়ী বিকাশ কুমার। এ দিন তিনি বললেন, ‘‘হোটেলের সামনে আবর্জনা থাকায় পছন্দ হয়নি। তাই ওখানে থাকিনি। তা না হলে আজ হয়তো মৃতের লম্বা তালিকায় আমার নামটাও থাকত!’’
প্রতিদিন ২০০’রও বেশি এমন প্রিমিয়াম খবর
সঙ্গে আনন্দবাজার পত্রিকার ই -পেপার পড়ার সুযোগ
সময়মতো পড়ুন, ‘সেভ আর্টিকল-এ ক্লিক করে