গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ
দীর্ঘ দিন ধরে ডিএ নিয়ে রাজ্য সরকারি কর্মীদের বঞ্চনা, তার উপর মুখ্যমন্ত্রীর ‘ঘেউ ঘেউ’ মন্তব্য। বহু দিন ধরেই সরকারি কর্মীদের ক্ষোভের আঁচ মিলছিল সোশ্যাল মিডিয়ায়। সেই ক্ষোভের আগুনই আছড়ে পড়ল ভোটযন্ত্রে। এঁদের সিংহভাগই যে রাজ্যের শাসক দল থেকে মুখ ফিরিয়ে বিজেপির ঝুলি ভরিয়ে দিয়েছেন, তার প্রমাণ মিলল ভোটের ফলে। রাজ্যের বিরোধী দলের কর্মী সংগঠনগুলি তো বটেই, তৃণমূলের সংগঠনও বিষয়টি মেনে নিয়েছে।
পোস্টাল ব্যালটের হিসেবে রাজ্যের ৪২টি আসনের মধ্যে ৩৯টিতেই এগিয়ে বিজেপি। একটি করে কেন্দ্রে জয়ী তৃণমূল, সিপিএম এবং কংগ্রেস। দক্ষিণ কলকাতায় তৃণমূলের মালা রায়, মুর্শিদাবাদে অধীর চৌধুরী এবং যাদবপুরের বাম প্রার্থী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য জিতেছেন। পোস্টাল ব্যালটে সরকারি কর্মীরা একচেটিয়া ভাবে তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছেন বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। পাশাপাশি ভোটের পর থেকেই সোশ্যাল মিডিয়ায় ফের শুরু হয়েছে এই নিয়ে নানা পোস্ট, মিম, ভিডিয়ো।
যে সব সরকারি কর্মী নিজের কেন্দ্রের বাইরে ভোটের ডিউটি করেন, তাঁদের জন্য পোস্টাল ব্যালটের ব্যাবস্থা করে নির্বাচন কমিশন। ভোট দেওয়ার পর সেগুলি নির্দিষ্ট গণনা কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গণনার দিন প্রথমেই গোনা হয় এই পোস্টাল ব্যালটের ভোট। আর সেই গণনাতেই তৃণমূলের শোচনীয় ফল।
কিন্তু কেন? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের ব্যাখ্যা, এর প্রথম কারণ মহার্ঘ ভাতা (ডিএ) নিয়ে রাজ্য সরকারের দীর্ঘ দিনের টালবাহানা। কেন্দ্রের সমান হারে ডিএ দেওয়ার দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরেই সরব সরকারি কর্মীরা। কিন্তু সেই দাবি তো মানা হয়ইনি, উল্টে আদালত পর্যন্ত বিরোধিতা করে এসেছে রাজ্য সরকার। ডিএ দয়ার দান নয়, সরকারি কর্মীদের অধিকার, কলকাতা হাইকোর্ট এ কথা বলার পরও স্যাট-এ ফের বিরোধিতা করেছে রাজ্য সরকার। দীর্ঘ এই আইনি লড়াই পেরিয়ে যাওয়ার পরও দাবি আদায় হয়নি সরকারি কর্মীদের।
এর সঙ্গে যোগ হয়েছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্য। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই একটি সভায় ‘ঘেউ ঘেউ’ মন্তব্য করেছেন। তাতে কার্যত অপমানিত বোধ করেছেন সরকারি কর্মীরা। সেই সময় ফেসবুক, হোয়াটস অ্যাপে এ নিয়ে প্রচুর প্রতিবাদ, ক্ষোভ ঝরে পড়েছিল।
আরও পড়ুন: বিগ ফোরে কারা, বাংলা থেকে কে কে, কত জন মন্ত্রী! নয়া মন্ত্রিসভা নিয়ে জল্পনা তুঙ্গে
সরকারি কর্মীদের একাংশের মতে, বন্ধ-সহ একাধিক বিষয় নিয়ে রাজ্য সরকারের ফতোয়াও অনেকটাই ইন্ধন জুগিয়েছে। যে কোনও দল বন্ধ, হরতালের ডাক দিলেই জারি হত কড়া নির্দেশিকা। রাজনৈতিক ভাবে বন্ধ ব্যর্থ করতে কর্মীদের উপস্থিত থাকতেই হবে এবং না হলে সার্ভিস বুকে প্রভাব পড়বে বলেও জারি হত বিজ্ঞপ্তি। ফলে প্রাণের ঝুঁকি নিয়েও এই সব দিনে অফিসে হাজির থাকতে হত সরকারি কর্মীদের। আবার নীচু তলার কর্মীদের কার্যত ইউনিয়ন করার অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এই সব বিষয়ই আছড়ে পড়েছে ভোটবাক্সে।
রাজ্য সরকারি কর্মীদের সংগঠনগুলিও এই সব অভিযোগেই সরব। বিজেপি অনুমোদিত সরকারি কর্মীদের সংগঠন কর্মচারী পরিষদের আহ্বায়ক দেবাশিস শীল বলেন, ‘‘একটার পর একটা বঞ্চনা— পে কমিশন-ডিএ না দেওয়া, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে কর্মীদের বদলি— এই সব কারণেই নিয়েই সরকারের বিরুদ্ধে কর্মীরা অনাস্থা প্রকাশ করেছেন। আগামীতেও সরকার বদলের জন্য যা যা করার দরকার, তাই করবেন তাঁরা। কারণ তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে বিজেপির প্রতিই তাঁরা আস্থা রেখেছেন।’’
আরও পড়ুন: বাবার কাছে হেরে গেলাম, মন্তব্যের পরেই তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড শুভ্রাংশু
কংগ্রেস অনুমোদিত সংগঠন কনফেডারেশনের নেতা সুবীর সাহার বক্তব্য, ‘‘সরকারের মূল ভিত্তি বা আস্থার প্রমাণই হচ্ছে সরকারি কর্মীরা। স্বেচ্ছাচারিতা এবং কর্মীদের উপর অফিসারদের দিয়ে অত্যাচার, ডিএ, পে কমিশন নিয়ে এই সরকার যে কর্মীদের প্রতি সহানুভুতিশীল নয়, তা প্রমাণিত। এছাড়া প্রচারে এসে মোদী-অমিত শাহরা ক্ষমতায় এলে ডিএ দেওয়ার ঘোষণা করেছেন। ত্রিপুরাতে আশ্বাস দিয়েছিলেন এবং ক্ষমতায় আসার পর তা বাস্তবায়িত হয়েছে। ফলে বিজেপির উপর সরকারি কর্মীরা আস্থা রেখেছেন।’’
বাম সংগঠন কো অর্ডিনেশন কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজয় শঙ্কর সিংহ বলেন, ‘‘রাজ্য সরকারি কর্মীদের মহার্ঘ ভাতা বাকি ৪১ শতাংশ। পে কমিশন নিয়ে অযথা টালবাহানা এবং তৃণমূলের যে ৮ বছরের শাসন চলছে, তার প্রতিফলন ভোটবাক্সে পড়েছে। কর্মচারীরা মনে করেছেন, তৃণমূলকে রুখতে গেলে বিজেপিকে আনতে হবে। তাই এই ফল।’’
কিন্তু বিরোধীদের চেয়েও বেশি সরব খোদ শাসক দলের সংগঠন। রাজ্য সরকারি কর্মচারী ফেডারেশনের মেন্টর গ্রুপের আহ্বায়ক মনোজ চক্রবর্তীর বক্তব্য, ‘‘ডিএ-পে কমিশন তো রয়েছেই, তার সঙ্গে অনেক দফতরে জুনিয়রদের উপর কার্যত অত্যাচার করা হয়েছে। তাঁদের ইউনিয়ন করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। কর্মীদের মাইনে বাড়লেও পেনশনারদের মাইনে নামমাত্র বাড়ে। এই বিরাট অংশের ক্ষোভ ভোটবাক্সে পড়েছে। এটা সরকারকে বুঝতে হবে। ট্রেড ইউনিয়ন করা যে গণতান্ত্রিক অধিকার, সেটা ফিরিয়ে দিতে হবে।’’
গ্রাফিক: শৌভিক দেবনাথ