বিধানসভায় হরকাবাহাদুর ছেত্রী। শুক্রবার। ছবি: রণজিৎ নন্দী।
‘মমতা-ঘনিষ্ঠ’ বলে যাঁকে দলের অন্দরে ‘বিপাকে’ ফেলার চেষ্টা করছিলেন গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার কিছু শীর্ষ নেতা, দল ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে তাঁদেরই বেকায়দায় ফেললেন কালিম্পঙের বিধায়ক হরকাবাহাদুর ছেত্রী।
মোর্চার ‘অস্বস্তি’র কারণ— প্রয়াত জিএনএলএফ নেতা সুবাস ঘিসিঙ্গের বিরুদ্ধে যে ‘একনায়কতন্ত্রের’ অভিযোগে বিমল গুরুঙ্গ গোটা পাহাড়কে পাশে পেয়েছিলেন, দল ছাড়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মোর্চার শীর্ষ নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কার্যত একই অভিযোগ তুলেছেন হরকা। নিজের পরের ‘গন্তব্য’ও ভাঙেননি। বিধানসভা ভোটের আগে হরকা শাসক দলের দিকে ঝুঁকলে পাহাড়ে মোর্চার আধিপত্য যে প্রশ্নের মুখে পড়বে, সে আশঙ্কা রয়েছে দলের অনেক নেতা-কর্মীরই।
বিধানসভা চত্বরে দাঁড়িয়ে শুক্রবার হরকা ঘোষণা করেন, ‘‘মোর্চায় ঠিকঠাক আলোচনা করে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছিল না। কিছু সিদ্ধান্ত চাপানো হচ্ছিল। এ বার ঠিক হয়ে গেল, বিধায়কেরা না কি ইস্তফা দেবেন। অথচ, সেটা বিধায়কেরাই জানলেন না!’’ তাঁর সংযোজন: ‘‘এ রকম পরিবেশে আমার পক্ষে আর মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না।’’
তবে মোর্চায় ঘনিষ্ঠদের দাবি, দলের শীর্ষ নেতাদের একাংশের কাজকর্মে হরকাবাহাদুর ক্ষুব্ধ অনেক দিনই। কারণও একাধিক—তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ‘সুসম্পর্ক’ নিয়ে মোর্চার অনেকের টিপ্পনী, অতীতে মুখ্যমন্ত্রী রেশম চাষ উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান পদে হরকাবাহাদুরকে বসাতে চাইলে গুরুঙ্গের তাতে বাধা দেওয়া—এমন অনেক কিছু। তাতেও দমেননি হরকা। বরং দিন কয়েক আগে বিমল গুরুঙ্গ রাজ্যের বিরুদ্ধে তোপ দাগার পরেও ডেলোয় গিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু বিনা আলোচনায় গুরুঙ্গ দার্জিলিং পাহাড়ে মোর্চার তিন বিধায়ক ইস্তফা দেবেন বলে আগাম ঘোষণা করে দেওয়ায়, হরকার পক্ষে অসন্তোষ লুকোনো সম্ভব হয়নি।
পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝতে অসুবিধা হয়নি গুরুঙ্গের। নয়াদিল্লি থেকে দার্জিলিং ফেরার পথে বাগডোগরায় তাঁর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি মনে করি, হরকাবাহাদুর ছেত্রী আমাদের সঙ্গে ছিলেন, আছেন, আগামীতেও থাকবেন। আমাদের দল ছেড়ে আগেও অনেকে চলে গিয়েছিলেন, পরে তাঁদের অনেকে ফিরেও এসেছেন।’’ দলীয় বিধায়কদের না জানিয়ে তাঁদের ইস্তফা দেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা নিয়ে হরকার অভিযোগ যে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়, সে ইঙ্গিতও স্পষ্ট গুরুঙ্গের মন্তব্যে। বলেছেন, ‘‘এখন কেউ ইস্তফা দেবেন না। সকলে মিলে বৈঠকের পরে কৌশল ঠিক হবে।’’
তবে গুরুঙ্গের হুঁশিয়ারি, ‘‘জাতিসত্ত্বার জন্য লড়ছি। দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা পেতে রাজি আছি। কোনও দিন বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। পাহাড়ের মানুষ তা পছন্দ করেন না।’’
ঘিসিঙ্গকে হটাতে পাহাড়ের যে ক’জন বিদ্বজ্জনকে সামনের সারিতে রেখেছিলেন গুরুঙ্গ, হরকা তাঁদের অন্যতম। বছর সাতান্নর এই বিধায়ক নেপালি কবি ভানুভক্ত থেকে শুরু করে রবীন্দ্রসঙ্গীত— সবেতেই সাবলীল। পিএইচডি করেছেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। পেশায় স্কুলশিক্ষক কালিম্পঙের চন্দ্রালোক এলাকার বাসিন্দা হরকাবাহাদুর।
জিএনএলএফ দিয়ে রাজনৈতিক জীবন শুরু করলেও হরকা এক সময় সে দল ছেড়ে তাদের সমালোচনা করতে ছাড়েননি। পরে ২০০০ সাল পর্যন্ত গোর্খা লিগে ছিলেন। ২০০৭-এ ঘিসিঙ্গ পাহাড়ে টানা বন্ধের ডাক দিলে বিদ্বজ্জনদের একত্রিত করে মোমবাতি-মিছিলের নেতৃত্ব দেন হরকা। সেই সূত্রে গুরুঙ্গ হরকাকে কালিম্পঙে মোর্চার অন্যতম নেতা হিসেবে ঘোষণা করেন।
কিন্তু বারবার পাহাড় সফর ও বিধানসভায় নানা আলোচনার সময়ে কালিম্পঙের বিধায়কের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে মুখ্যমন্ত্রীর। পাহাড়ের ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে হরকার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী আলোচনা করতেন বলে মোর্চা সূত্রের দাবি। তাতেই গুরুঙ্গ ক্ষেপে ওঠেন। মোর্চার শীর্ষ নেতৃত্বের সন্দেহ হয়, পাহাড়ে বিভাজনের রাজনীতি করছে তৃণমূল। তাই দলের অন্দরে কালিম্পঙের বিধায়ককে কোণঠাসা করার চেষ্টা শুরু হয়।
পাহাড়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত তৃণমূল নেতা বিন্নি শর্মা অবশ্য বলেন, ‘‘তৃণমূল বিভাজনের রাজনীতি করে না। হরকাবাহাদুর নিজগুণেই সমাদৃত।’’ তৃণমূল সূত্রের অবশ্য দাবি, হরকা শাসক দলে যোগ দিলে বা নিজস্ব দল গড়ে পরবর্তী নির্বাচনে জোট-সঙ্গী হলে পুরস্কার হিসেবে তাঁকে মন্ত্রীও করা হতে পারে।
হরকা জানিয়েছেন, দিনকয়েক বাদে কলকাতা থেকে পাহাড়ে ফিরে বুঝে নিতে চান, তাঁর সিদ্ধান্তে কালিম্পঙের মানুষের প্রতিক্রিয়া কী। তার পরে পরবর্তী পদক্ষেপ ঠিক করবেন। কিন্তু পাহাড়ে তো জল্পনা তুঙ্গে যে হরকা তৃণমূলেই যাবেন? বিধায়কের প্রতিক্রিয়া, ‘‘মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আমার অন্তত ৫০ বার দেখা বা কথা হয়েছে। তা বলেই কি একটা কিছু ধরে নিতে হবে?’’