প্রতীকী চিত্র।
মা বলেছিলেন, চার দিন পরে বাড়ি ফিরবেন। মোবাইল ফোনে পাঁচ বছরের মেয়ের আদুরে গলায় কাকুতিমিনতি, তার আগেই আসতে হবে। আগে এলে মাকে সে ম্যাগি খাওয়াবে। মায়ের চুল বেঁধে দেবে। মা অবশ্য ‘ডিউটি’র খাতিরে আগে পৌঁছনোর কথা দিতে পারেনি আত্মজাকে।
মেয়েটির মা সোমা দেব শ্রীরামপুর শ্রমজীবী হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী। বাড়ি নবদ্বীপে। কিছু দিন পর পর বাড়ি যেতেন। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে একে গাড়ির সমস্যা, তায় শ্রমজীবী কোভিড হাসপাতাল হওয়ায় বাড়ি ফেরা হয়নি। সম্প্রতি মা-মেয়ের ওই কথপোকথন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কানে যায়। পরের দিনই ছুটি দিয়ে তাঁকে বাড়ি পাঠানো হয়।
শুধু সোমা নন, ওই হাসপাতালে নারী-ব্রিগেডের অনেকেই বাড়ির সঙ্গে সংযোগ কার্যত ভুলে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন। কেউ স্বামী-সন্তান, সংসার ফেলে। কেউ বৃদ্ধ বাবাকে একা বাড়িতে রেখে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানান, করোনা চিকিৎসা প্রথম দিকে ছিল কার্যত অজানার বিরুদ্ধে লড়াই। সমাজে ভীতি-বিভ্রান্তিতে অভূতপূর্ব পরিবেশ তৈরি হয়েছিল। তার উপরে লকডাউনের গেরো। সব মিলিয়ে হাসপাতাল ছেড়ে বেরনোর জো ছিল না। কোভিড-হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে সমাজের তাচ্ছিল্য তো ছিলই! এখন পরিস্থিতি কিছুটা শুধরেছে। তবে, ‘যুদ্ধ’ থামেনি। মেয়েদের এই লড়াইকে কুর্নিশ করছেন চিকিৎসক থেকে স্বাস্থ্যকর্তা— সকলেই।
জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক শুভ্রাংশু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘বিভিন্ন হাসপাতালেই চিকিৎসকের পাশাপাশি নার্স-সহ স্বাস্থ্যকর্মীরা এক অন্য লড়াইও চালিয়ে গিয়েছেন। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কোভিড চিকিৎসায় শ্রমজীবী যে ভরসার জায়গা হয়ে দাঁড়িয়েছে, সে জন্য ওখানকার মেয়েদের অবদান অনস্বীকার্য।’’ হাসপাতালের সম্পাদক তথা বর্ষীয়ান চিকিৎসক অনিল সাহা, কুণাল দত্তেরও একই অভিমত।
ভদ্রেশ্বরের মৌসুমি দাস ওই হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মী। বাবা-মেয়ের সংসার। বাবা সেরিব্রাল অ্যাটাকের রোগী। প্রতিদিন ডিউটি সেরে মৌসুমি বাড়ি ফিরতেন। ছুটির দিন দিব্যি কেটে যেত বাবার সঙ্গে। করোনা সেই রুটিনে ছেদ ফেলে। অতিমারির সময়ে ছুটি না নিয়ে হাসপাতালে থাকাকেই বেছে নেন তিনি। এক প্রতিবেশী দম্পতি তাঁর বাবার খেয়াল রাখেন। এখন অবশ্য মৌসুমী এক সপ্তাহ অন্তর বাড়িতে যাচ্ছেন। করোনা-ভীতিতে রিঙ্কু শতপথী ভেবেছিলেন, বাড়ি ফিরে যাবেন। অভিভাবকরাও চাইছিলেন না, ‘ঝুঁকি’র চিকিৎসায় মেয়ে জড়িয়ে থাকুন। কিন্তু এই ভাবে অন্য মেয়েরাও পিছিয়ে গেলে চিকিৎসা করবেন কে! এই ভাবনায় রিঙ্কু মত বদলান। বাড়ির লোকেরাও তখন পিঠ চাপড়ানি দিয়ে তাঁকে
‘যুদ্ধক্ষেত্রে’ পাঠিয়ে দেন। তখন থেকে কোভিড-রোগীদের চিকিৎসায় মগ্ন তরুণী। গত পাঁচ মাসে এক দিনও বাড়ি যাননি।
মৌসুমী বলেন, ‘‘যখন জানলাম অচেনা ভাইরাসের সাথে লড়াইতে নামতে হবে, খুব ভয় পেয়েছিলাম। কিন্তু এই লড়াই আমরা করবো না, এমনটা এক বারের জন্যও মাথায় আসেনি। বাড়ির লোকেরাও সাহস জুগিয়েছেন। এর পরেও ভয়, চিন্তা, মনখারাপ হয়েছে। মানসিক সমস্যা হয়েছে। কিন্তু যখনই ওয়ার্ডে ঢুকেছি, সে সব উবে গিয়েছে। আপনাআপনিই মনোবল বেড়ে গিয়েছে।’’ পরিস্থিতি জয় করতে একে অপরকে সাহস দিয়ে
গিয়েছেন মেয়েরা।
হাসপাতালের সহ-সম্পাদক শিল্পী ঘোষ বলেন, ‘‘একটা অদ্ভুত সময় কাটল আমাদের। এখনও চলছে। গণ-উদ্যোগে তৈরি এই হাসপাতালে ওদের বেতন আহামরি কিছু নয়। কিন্তু নিজেদের কথা না ভেবে রোগীদের ব্লাড প্রেশার, অক্সিজেনের মাত্রা মেপে দেখা বা ওষুধ-ইঞ্জেকশন দেওয়া শুধু নয়, তাঁদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে মানসিক ভাবে চাঙ্গা করে তুলতেও মেয়েরা পিছুপা হয়নি। ওদের জন্য গর্ব হয়।’’
ওয়ার্ডে ঢুকলেই এই মেয়েরা যেন এক এক জন ‘ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল’।
(জরুরি ঘোষণা: কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের জন্য কয়েকটি বিশেষ হেল্পলাইন চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এই হেল্পলাইন নম্বরগুলিতে ফোন করলে অ্যাম্বুল্যান্স বা টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত পরিষেবা নিয়ে সহায়তা মিলবে। পাশাপাশি থাকছে একটি সার্বিক হেল্পলাইন নম্বরও।
• সার্বিক হেল্পলাইন নম্বর: ১৮০০ ৩১৩ ৪৪৪ ২২২
• টেলিমেডিসিন সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-২৩৫৭৬০০১
• কোভিড-১৯ আক্রান্তদের অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা সংক্রান্ত হেল্পলাইন নম্বর: ০৩৩-৪০৯০২৯২৯)