চলছে তাঁত বোনা। ছবিটি তুলেছেন দীপঙ্কর দে।
মহাজনের দিকে তাকিয়ে সাবেক পদ্ধতিতে তাঁত চালিয়ে সংসার চালাতে তাঁদের নুন আনতে পান্তা ফুরোয়। গুপ্তিপাড়ার ঐতিহ্যবাহী তাঁত-শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে তাঁতিদের দাবি ছিল ক্লাস্টারের। অর্থাৎ, একই ছাদের তলায় তাঁত-শিল্প নিয়ে প্রশিক্ষণের সুযোগ, ন্যায্য দামে শিল্পের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনা এবং তাঁতবস্ত্র বিক্রির সুবিধা। অবশেষে, সেই ক্লাস্টার গড়ার প্রক্রিয়া শুরু হল। তাঁতিদের আশা, প্রকল্পটি সম্পূর্ণ হলে তাঁরা লাভবান হবেন।
তাঁতিদের নিয়ে কাজ করে, স্থানীয় এমন একটি সংস্থার তরফে জেলা হ্যান্ডলুম দফতরে এ নিয়ে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ করা হয়েছে। সংস্থার তরফে বিশ্বজিৎ নাগ বলেন, ‘‘জমি খোঁজা হচ্ছে। আশা করছি শীঘ্রই পাওয়া যাবে। ক্লাস্টারে কারা আসবেন, সেই তাঁতিদের সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়ে জেলা হ্যান্ডলুম দফতরে পাঠানোর কাজ চলছে।’’ওই দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, তাঁতিদের তথ্য-সহ আবেদন পেলে পরবর্তী কাজ হবে।
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের প্রতিমন্ত্রী স্বপন দেবনাথ বলেন, ‘‘গুপ্তিপাড়া তাঁতের পুরনো জায়গা। যথাযথ প্রস্তাব জমা পড়লেই বিষয়টি নিয়ে সমীক্ষা করে কাজ এগোনো হবে।’’
গুপ্তিপাড়া-১ ও ২, সোমড়া-১, চরকৃষ্ণবাটি, বাঁকুলিয়া-ধোবাপাড়া— বলাগড় ব্লকের এই পাঁচটি পঞ্চায়েত এলাকায় কয়েকশো মানুষ তাঁত বোনেন। আনুষঙ্গিক কাজ করেন আরও কয়েকশো গ্রামবাসী। শাড়ি বুনে তাঁরা মহাজনের হাতে তুলে দেন। মহাজন সেই শাড়ি নদিয়ার শান্তিপুর, ফুলিয়া বা বর্ধমানের সমুদ্রগড়ে নিয়ে গিয়ে বিক্রি করেন। পুরনো এই পদ্ধতিতে তাঁরা সে ভাবে লাভের মুখ দেখতে পান না বলে তাঁতিদের অভিযোগ। বিধানসভা নির্বাচনের আগে গুপ্তিপাড়ায় ক্ষুদ্র কুটির শিল্প দফতরের একটি অনুষ্ঠানে মন্ত্রী স্বপনবাবুর (তখনও ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের প্রতিমন্ত্রী ছিলেন) কাছে ক্লাস্টার গড়ার দাবি জানানো হয় তাঁতিদের তরফে। মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, যথাযথ ভাবে আবেদন করলে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এর পরেই ক্লাস্টার গড়ার ব্যাপারে তোড়জোড় শুরু হয়।
ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতর সূত্রের খবর, ক্লাস্টার তৈরি করতে ৫ কাঠা জমির প্রয়োজন। ক্লাস্টারে ‘কমন ফেসিলিটি সেন্টার’ থাকবে। সেখানে সুতো রং করার ব্যবস্থাও থাকবে। জাতীয় তাঁত উন্নয়ন নিগম থেকে সুতো এনে সেই সুতো ভর্তুকি-সহ তাঁতিদের বিক্রি করা হবে। উৎপাদিত শাড়ি তাঁতি ক্লাস্টারে দিয়ে যাবেন। এখান থেকে শাড়ি কিনে নিয়ে যাবে তন্তুজ, তন্তুশ্রী, মঞ্জুষার মতো সরকারি সংস্থা। ক্লাস্টারে তাঁতিদের উন্নত প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। গোটা প্রকল্পটি তৈরি করতে ১ কোটি টাকার বেশি খরচ হবে।
তাঁত-শিল্পকে পুনরুজ্জীবিত করতে রাজ্য সরকার ‘তাঁতি সাথী’ নামে একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। ওই প্রকল্পে নিজস্ব তাঁত নেই অথবা নষ্ট হয়ে গিয়েছে— এমন তাঁতিদের বেছে নিয়ে তাঁত এবং সরঞ্জাম দেওয়া হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প দফতরের উদ্যোগে বিধানসভা ভোটের আগে গুপ্তিপাড়ায় এক অনুষ্ঠানে শ’চারেক তাঁতিতে তাঁত ও সামগ্রী দেওয়া হয়েছে। ফের দেওয়া হবে বলে ওই দফতর সূত্রের খবর।
তাঁত ও সামগ্রী পেয়ে তাঁতিরা উপকৃত হচ্ছেন ঠিকই। কিন্তু ক্লাস্টার প্রকল্পটি হলে তাঁরা আরও বেশি উপকৃত হবেন বলে মনে করছেন গুপ্তিপাড়ার তাঁতিরা। দু’দশক ধরে তাঁত বোনেন পাইগাছি গ্রামের আনসার আলি মল্লিক। তিনি বলেন, ‘‘ক্লাস্টার হলে মহাজনের দিকে তাকিয়ে না থেকে সরাসরি বাজারমুখো হওয়া যাবে।’’ বলাগড়ের চরকৃষ্ণবাটির কলতলার গৃহবধূ মনিকা হালদার বা সোমড়া-১ পঞ্চায়েতের কামারডাঙার জামদানি শিল্পী খোকন ঘোষের গলাতেও এক সুর। তাঁদের বক্তব্য, ‘‘ক্লাস্টার হলে প্রশিক্ষণ মিলবে। পুরনো পদ্ধতি ছেড়ে নতুন ভাবে প্রযুক্তির সাহায্য নিয়ে শাড়ি তৈরি করা যাবে।’’
নতুন প্রকল্পের দিকেই এখন তাকিয়ে এখানকার তাঁতিরা।