কামারপুকুরের রুগ্‌ণ যাত্রা বাঁচে পুজো আঁকড়েই

কামারপুকুরের মুমূর্ষু ১৭টি যাত্রাদল প্রতিবছরই পুজোর সময় জেগে ওঠে। প্রতিদিন দু’বেলা চলে মহড়া— এক-দেড় মাস।

Advertisement

পীযূষ নন্দী

গোঘাট শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৮ ০২:৫৯
Share:

প্রচার: পুজো উপলক্ষে যাত্রাপালার বিজ্ঞাপন। নিজস্ব চিত্র

থিয়েটার যাত্রায় ‘লোকশিক্ষা হয়’— মনে করতেন শ্রীরামকৃষ্ণ। তাঁর জীবনেও যাত্রাপালার একটা বড় মাহাত্ম্য রয়ে গিয়েছে। লোকমুখে শোনা যায় কামারপুকুরে পাইনবাড়িতে যাত্রা চলার সময়ই প্রথম ভাব সমাধি হয়েছিল ছোট্ট গদাধরের। প্রাচীন কামারপুকুর আজও সেই যাত্রার ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। তবে সে বড় কষ্ট করে। সারা বছর দিন মজুরি করতে হয় অভিনেতা এমনকি দলের মালিককেও। শুধু পুজোর আগে কামারপুকুর চটিতেই অস্থায়ী অফিস খোলে অপেরাগুলি।

Advertisement

কামারপুকুরের মুমূর্ষু ১৭টি যাত্রাদল প্রতিবছরই পুজোর সময় জেগে ওঠে। প্রতিদিন দু’বেলা চলে মহড়া— এক-দেড় মাস। ষষ্ঠীর দিন থেকেই বায়না। যেতে হবে হুগলির বিভিন্ন জায়গায়। তা ছাড়া, বর্ধমান, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া এবং পশ্চিম মেদিনীপুরের নানা ক্লাবের পুজো মণ্ডপে ডাক পড়ে তাদের।

শতাব্দী প্রাচীন কামারপুকুরের যাত্রা ঐতিহ্য। বহু দল বন্ধ হয়ে গিয়েছ। আবার নতুন করে গড়েও উঠেছে বহু দল।

Advertisement

টানা ৩৬ বছর ধরে যাত্রা জগতের সঙ্গে যুক্ত ‘নিউ রায় অপেরা’র মালিক ও দলের নায়ক শান্তি রায় বলেন, “আমাদের ভরসা শুধু পুজো কমিটিগুলি। বছরে বড় জোর

১২০-১৫০ দিন কাজ হয়। বাকি দিন বেশিরভাগ শিল্পীই দিনমজুরি করে সংসার প্রতিপালন করেন।’’ তাঁর আক্ষেপ, সরকারও এ বিষয়ে তেমন আগ্রহী। পঞ্চায়েতও কিছুই করে না।

একই অভিযোগ তুলেছেন গণেশ অপেরার মালিক এবং নায়ক সব্যসাচী মৌলিক, জগদ্ধাত্রী অপেরার নীলিমা বৈরাগ্য, শিল্পীচক্র অপেরার স্বপন মণ্ডল, পুষ্পাঞ্জলি অপেরার দিলীপ অধীকারী, রাজদীপ অপেরার রূপকুমার, শতদল অপেরার শান্তি দে-রাও। তাঁদের খেদ, যাত্রার সাবেকি গন্ধ হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষের সেই টান আর নেই। স্বপনবাবু বলেন, ‘‘আগে গ্রামে গ্রামে রেষারেষি চলত যাত্রা নিয়ে। পুজো তো বটেই বিয়ে বাড়িতেও যাত্রা হত। এখন শুধু ক্লাবগুলোই ভরসা।’’ দিলীপ অধিকারী বলেন, “কলকাতায় যাত্রাদলগুলিকে নিয়ে নতুন করে ভাবছে রাজ্য সরকার। আমারা কি ফেলনা? সরকারি স্তরে দলগুলির পরিকাঠামো তৈরির জন্য ঋণ বা অনুদানের ব্যবস্থা হোক।”

কামারপুকুরের সবচেয়ে দামি অভিনেতা রাজদীপ অপেরার শ্যামল মাজি। বছর আটচল্লিশের নায়ক বলেন, “গত ২২ বছর এখানে বিভিন্ন অপেরায় আছি আমি। দলগুলি এমনই দুঃস্থ যে শিল্পীদের খোলা ম্যাটাডোরে চড়ে যেতে হয় অভিনয় করতে। উপযুক্ত পারিশ্রমিক মেলে না। শুধু যাত্রার নেশায় আমরা অভিনয় করে চলেছি।’’ কিন্তু নতুন প্রজন্ম আগ্রহী নয় অভিনয়ে।

যাত্রাদলগুলির থেকে জানা গিয়েছে, একমাত্র শ্যামলবাবুই এক রাতে মজুরি পান ১৮০০ টাকা। অন্য নায়ক নায়িকারা কেউ পান ৮০০ টাকা, কেউ হাজার টাকা। অন্য শিল্পীরা পান ৩০০ টাকা। এক একটি দলে অভিনেতা, মেকআপ শিল্পী, রান্নার লোক— সব মিলিয়ে ২৫ জন থাকেন। দুর্গাপুজোর সময় ওইসব যাত্রাদলগুলি প্রতি রাতের ১৬ হাজার টাকা থেকে ১৮ হাজার টাকা পায়। কালীপুজোর সময় থেকেই সেই দর কমতে শুরু করে। তখন মেলে ৮-১০ হাজার টাকা। ফলে শিল্পীদের অবস্থা শোচনীয়।

সময় এবং টাকার অভাবে বাদ পড়ে যাত্রার অনেক অঙ্গ। বদলে গিয়েছে মানুষের রুচি, পছন্দও শ্যামলবাবুরা জানালেন, প্রথম দৃশ্যে আদ্যাশক্তি মহামায় নাচ এখন আর হয় না। প্রতিটি অঙ্কের শুরুতে সখীদের নাচও বন্ধ। টিঁকে আছে মঞ্চে ঘণ্টা দেওয়ার রীতিটি।

যাত্রা শিল্পে সঙ্কটের কথা স্বীকার করে কামারপুকুর পঞ্চায়েত প্রধান তপন মণ্ডল বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি দলগুলিকে ট্রেড লাইসেন্স করিয়ে দিতে। পঞ্চায়েত স্তরে একটা প্রাথমিক পরিকাঠামো গড়ে দেওয়ার চেষ্টা হবে।’’ সরকারি লোকপ্রসার প্রকল্পের আওতায় শিল্পীদের অন্তর্ভুক্ত করার আশ্বাসও দেন তিনি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন