মঙ্গলবার দুপুর। ডানলপ মোড়ে দাঁড়িয়ে হন্যে হয়ে ট্যাক্সি খুঁজছেন দুই মহিলা। গন্তব্য মিন্টো পার্ক। কিন্তু বিটি রোডের ধারে সার দিয়ে ছ’টি ট্যাক্সি থাকলেও কেউ যেতে চাইছেন না। শেষে এল ‘ডব্লিউ বি ০৪ ডি ৮০৬১’ নম্বরের একটি ট্যাক্সি। চালক মিন্টো পার্ক শুনেই বললেন, “অত দূরে যাব না। ছোট রুট হলে যাব।” এর পরেই আর স্ট্যান্ডে না ঢুকে টবিন রোডের দিকে চলে গেল সেই ট্যাক্সিটি।
ওই স্ট্যান্ডেই দাঁড়ানো আর একটি ট্যাক্সির (ডব্লিউ ০৪এফ ১০৬২) চালক বললেন, “আজ ওদিকে যানজট। তাই কেউ যাচ্ছি না। বালি, সোদপুর হলে যাব।” এই কথাবার্তার মধ্যেই এগিয়ে এলেন এক যুবক। জটলা করে থাকা চালকদের উদ্দেশে বললেন, “তোরা কী যে করিস! ভাড়া নিয়ে যা।” জানা গেল ওই যুবক হলেন টবিন রোডমুখী ডানলপ মোড়ের ওই ট্যাক্সি স্ট্যান্ডের স্টার্টার। কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পরে দেখা গেল ওই যুবকই প্রতিটি ট্যাক্সি থেকে রীতিমতো কুপন কেটে ১০ টাকা করে চাঁদা তুলছেন।
কলকাতায় ট্যাক্সির এ হেন যাত্রী-প্রত্যাখানের চিত্র নতুন কিছু নয়। কিন্তু সম্প্রতি মুখ্যমন্ত্রী জরিমানা কমানোর কথা ঘোষণার পরে শহর তো বটেই যাত্রী প্রত্যাখানের ভূরি ভূরি অভিযোগ উঠছে শহরতলির ট্যাক্সিচালকদের বিরুদ্ধেও। একাংশ ট্যাক্সিচালকের কথায়, “জরিমানা কমিয়ে দেওয়ার ফলে অনেকেই আরও সাহস পেয়ে গিয়েছেন।” এরই প্রমাণ মিলল মঙ্গলবার দুপুরে বালি, দক্ষিণেশ্বর, কামারহাটি এলাকায় চক্কর মেরে।
এ দিন দুপুরে বালি ৫৪ বাস স্ট্যান্ডের সামনে দেখা গেল পাঁচটি ট্যাক্সি। ‘ডব্লিউ বি ১৯এফ ৪৮৬৪’ নম্বরের ট্যাক্সির চালককে জিজ্ঞাসা করা হল ‘ডানকুনি যাবেন?’ শুনে বিরক্তি প্রকাশ করে চালক বললেন, “সামনের দিকে যান।” কিন্তু সেখানেও ডানকুনি যাওয়ার কথা শুনেই এড়িয়ে গেলেন ‘ডব্লিউ বি ০৪ডি ৮৯১৬’ নম্বরের ট্যাক্সির চালক।
আবার বালিঘাট স্টেশনের নীচে জিটি রোডের ধারেই দাঁড়িয়ে ‘ডব্লিউ বি ২৫ এ ৯৮৪৮’ নম্বরের ট্যাক্সি। শিবপুর যাবে কি না জানতে চাইলেন বালির বাসিন্দা সোমেন রায়। কিন্তু ট্যাক্সিচালক জানালেন মঙ্গলাহাটের যানজট রয়েছে। তাই ৬ নম্বর জাতীয় সড়ক হয়ে ঘুরে যেতে হবে। কিন্তু ওই পথে গেলে বেশি ভাড়া উঠবে-সোমেনবাবু এই কথা বলতেই চালক বললেন, “তা হলে যাব না।”
রাস্তার ধারে যত্রতত্র ট্যাক্সি পার্কিং করলেও পুলিশকে বিষয়টি সহানভূতির সঙ্গে বিবেচনা করারও নির্দেশ দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। আর সেই জোরেই শহরতলির জিটি রোড থেকে বিটি রোডে যেখানে সেখানে দাঁড়িয়ে পড়ছে ট্যাক্সি। আর নির্দিষ্ট স্ট্যান্ড না হওয়ায় ওই ট্যাক্সির চালকেরা যাত্রী প্রত্যাখান করলেও কাউকে কিছু জানানোর কোনও উপায় থাকছে না বলেই অভিযোগ যাত্রীদের।
দক্ষিণেশ্বর স্টেশনের পাশেই সার দিয়ে ট্যাক্সি। চালকের মর্জিমতোই চলছে প্রত্যাখ্যান। যেমন, শিয়ালদহ যাওয়ার জন্য দক্ষিণেশ্বর স্টেশনের পাশে স্ট্যান্ডে গিয়ে ট্যাক্সি খুঁজছিলেন এক দম্পতি। কিন্তু শিয়ালদহ গেলে খালি ফিরতে হবে, তাই ৩৫০ টাকা ভাড়া দাবি করে বসলেন ওই স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো ‘ডব্লিউ বি ০৪ ই ৬৫৫৩’ নম্বরের ট্যাক্সির চালক।
কসবা যাবেন দীপকুমার গোস্বামী। কিন্তু দক্ষিণেশ্বর মোড়ের কাছে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ওঠার রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা ‘ডব্লিউ বি ১১এ ৩৯৬৩’ নম্বরের ট্যাক্সির চালক জানালেন তিনি যেতে পারেন। কিন্তু নিউ টাউন হয়ে ঘুরে যাবেন। তাতে সাড়ে চার কিমি বেশি হবে। দীপবাবু অবশ্য রাজি হননি। তিনি বললেন, “ঘুর পথে বেশি টাকা দিয়ে কেন যাব বলুন তো। কাকে অভিযোগ করব!”
২০১৪-র জুলাই থেকে ট্যাক্সিচালকদের শৃঙ্খলায় আনার জন্য শহরের বিভিন্ন জায়গায় ‘ট্যাক্সি-বে’ চালু করেছে কলকাতা পুলিশ। কিন্তু শহরতলিতে সেই ব্যবস্থা আজও গড়ে ওঠেনি বলেই অভিযোগ ট্যাক্সিচালক সংগঠনের নেতাদেরও। যেমন বেঙ্গল ট্যাক্সি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বিমল গুহ বলেন, “শহরতলিতেও কোথাও সরকারি স্ট্যান্ড নেই। সর্বত্রই রাজনৈতিক দলের লোকেরা টাকার বিনিময়ে স্ট্যান্ড নিয়ন্ত্রণ করছেন। আর তাই চালকেরাও দাদাগিরি করছে।”
তবে যাত্রীরা নম্বর দিয়ে অভিযোগ জানালে পুলিশ নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নেবে বলেই দাবি হাওড়া সিটি পুলিশের ডিসি (ট্রাফিক) সুমিত কুমারের। তিনি আরও বলেন, “একটা নির্দিষ্ট জায়গায় ট্যাক্সি দাঁড় করাতে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।” ব্যারাকপুর কমিশনারেটের এক শীর্ষ পুলিশ কর্তা বলেন, “বিষয়টা নজরে এসেছে। দেখা হচ্ছে।”