টাউন লাইব্রেরি।
সরস্বতী পুজো নিয়ে দুর্গাপুজোর মতোই মেতে ওঠে এ শহর। বিদ্যার দেবীর আরাধনায় শহরবাসীর অপার ভক্তি এখানকার সংস্কৃতি আর ইতিহাস থেকেই স্পষ্ট মালুম হয়। যার সঙ্গে সমানে সঙ্গত করে চলেছে শহরের ক্রীড়াচর্চা। হুগলির এই শহরে ক্রীড়াচর্চায় মেয়েরা যথেষ্ট এগিয়ে। এখানকারই মেয়ে অনুশ্রী ঘোষ এশিয়াডে ভলিবলে ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। গ্রুপ থিয়েটার, যাত্রা আর লোকশিল্পেও যথেষ্ট খ্যাতি এই জনপদের। কিন্তু শহরের ইতিহাস নিয়ে শহরবাসীর অনাগ্রহের ছবি যেন ‘বাঙালি ইতিহাস বিস্মৃত জাতি’ কথাটাকেই মনে করিয়ে দেয়।
ডিরোজিওর হাত ধরে হিন্দু কলেজকে সামনে রেখে সমাজ সংস্কারে তাঁর হাতেখড়ি মাত্র নয় বছর বয়সে। সময় যতই গড়িয়েছে তাঁর কাজের পরিধি ততই বেড়েছে। জন্মসূত্রে মগরার বাগাটির বাসিন্দা নন তিনি। কিন্তু সেই সময়ে গ্রাম বাংলার প্রত্যন্ত জনপদ বাগাটি বাবু রামগোপাল ঘোষকে তাঁকে কাজ দিয়েই চিনে নিয়েছিল। কিন্তু এখনকার প্রজন্ম? তাঁরা কী ব্রিটিশ আমলের ‘বাবুকে’ মনে করতে পারেন?
ইতিহাস বলছে, আদতে তাঁর জন্মকাল থেকে ২০০ বছরেরও বেশি সময় পেরিয়ে গিয়েছে। নারী শিক্ষা, সমাজের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থা, বিধবা বিবাহ প্রচলন সব ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর জাত চিনিয়েছিলেন অনায়াসে। ব্রিটিশ শাসনে শিক্ষা প্রসারের ক্ষেত্রে নীতিগত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে যে গুটিকয় ভারতীয়র মতকে গুরুত্ব দেওয়া হত রামগোপাল ঘোষ ছিলেন তার অন্যতম। আবার প্রয়োজনে শিরদাঁড়া সোজা রাখা মানুষটি ব্রিটিশরাজের দেওয়া পদ ফিরিয়ে দিতে এক দণ্ডও ভাবেননি। প্রত্যাখ্যান করেছেন মোটা বেতনের বিচারকের চাকরিও।
বস্তুত, রামগোপাল শিক্ষাদীক্ষায় সমৃদ্ধ পরিবারের প্রতিনিধি ছিলেন। গ্রামের গোপাল থেকে ব্রিটিশরাজের দেওয়া খেতাব বাবু রামগোপাল হয়ে ওঠার নেপথ্যে তাঁকে অনেক পথ পার হতে হয়েছে। বাবা গোবিন্দচন্দ্র ঘোষ কোচবিহারের রাজার কলকাতাস্থ ব্যবসার মূল প্রতিনিধি ছিলেন। হিন্দু কলেজের ছাত্র গোপাল আদতে ইতিহাস এবং ভূগোলে দড় ছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়েসে তিনি সেকেন্ড ক্লাসে উন্নীত হন।
কলকাতা-সহ রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় স্কুল, কলেজ প্রতিষ্ঠা ও নারী শিক্ষার প্রসারে সরাসরি কাজ শুরু করেন তিনি। মাঝে তাঁকে পরিবারের হালও ধরতে হয়। কলকাতায় কাজকর্ম বজায় রাখলেও ধীরে ধীরে মগরার সঙ্গে তাঁর যোগ বাড়ে। শুরু করেন ব্যবসা। এর মাঝেই তিনি কলকাতায় অ্যাকাডেমিক অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তোলেন। মূলত নারীশিক্ষা প্রসার ও দর্শনের উপর কাজ করতেন এঁরা। যার সভাপতি ছিলেন তিনি। সুবক্তা হিসাবে খ্যাতি ছিল রামগোপালের। সে সবের বেশিরভাগই ছিল ইংরাজিতে বলা। তাঁর ভাষণ তখন টাইমসে্র মতো বিখ্যাত নানা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হতো।
তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে রামগোপালের স্মৃতি ফিকে হয়েছে এ শহরে। বতর্মান প্রজন্মের প্রায় সকলেই তাঁর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানেন না। বাগাটির এক প্রবীণের কথায়, “এর জন্য বর্তমান প্রজন্মের দোষ নেই। দায় আমাদের। কারণ আমরা সচেতন নয়। এই প্রজন্মের কাছে রামগোপালের মতো মানুষকে পৌঁছে দিতে সরকারি, বেসরকারি কোনও ক্ষেত্রেই তেমন জোরালো পদক্ষেপ দেখা যায়নি।”
তবে এ ধরনের আক্ষেপ যেমন রয়েছে, তেমন বাগাটি থেকে রামগোপালের স্মৃতি যে ধুয়েমুতে গিয়েছে তাও নয়। এখনও অস্তিত্ব রয়েছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্কুল, বসতবাটির। তাঁর উপরে প্রামাণ্য তথ্য সহ বিশিষ্ট অধ্যাপক বারিদবরণ ঘোষের একটি বইও রয়েছে।
বাবু রামগোপালের প্রতিষ্ঠিত স্কুলে এখন শিক্ষকতা করেন শঙ্কর পাল। তাঁর কথায়, “ইতিহাসের টানেই ওঁকে নিয়ে পড়াশোনা করি। ওঁর কাজের ব্যাপ্তি আর পরিধি দেখে আশ্চর্য হয়ে যাই। দীনবন্ধু মিত্র, গিরিশচন্দ্র ঘোষ, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের মতো বিদগ্ধ ব্যক্তিরা তাঁর কাজের প্রশংসা করেছেন।”
তবে ইতিহাস, সংস্কৃতির নানা আকরে সমৃদ্ধ এই শহর আজও পায়নি তার সুষ্ঠু আত্মপ্রকাশের জন্য উপযুক্ত মঞ্চ। শহরে আজও গড়ে ওঠেনি কোনও প্রেক্ষাগৃহ। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের প্রয়োজনে মণ্ডপ বেঁধে খোলা মাঠই ভরসা। কিন্তু অন্যদিকে রয়েছে টাউন লাইব্রেরি। নদীর পাড়ও বাঁধানো হয়েছে সাংসদ আর পঞ্চায়েত সমিতির টাকায়।
স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান প্রিয়াঙ্কা মুখোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়ছেন কুন্তী নদীর পাড় বাঁধিয়ে বৃদ্ধদের হাঁটার পাশাপাশি সৌন্দর্যায়নের জন্য প্রকল্প তৈরির কথা। মগরার ভলিবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রশিক্ষক প্রভাত ঘোষের হাত ধরে কমলিকা দেবনাথ আর কস্তুরি দুবেরা জাতীয় স্তরে সাড়া ফেলেছেন।
তবু এত সবের মধ্যেও সংস্কৃতির চর্চার কেন্দ্র হিসেবে শহরে একটি প্রেক্ষাগৃহ না থাকার ঘটনা প্রতি মুহূর্তে নাড়া দিয়ে যায় শহরবাসীকে।
(শেষ)
ছবি: তাপস ঘোষ।
কেমন লাগছে আমার শহর? নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু
বলার থাকলে আমাদের জানান। ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
subject-এ লিখুন ‘আমার শহর মগরা’। ফেসবুকে প্রতিক্রিয়া জানান:
www.facebook.com/anandabazar.abp অথবা চিঠি পাঠান
‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,
কলকাতা ৭০০০০১ ঠিকানায়।