আন্দুল

সংস্কৃতি চর্চার মঞ্চ চায় আন্দুল

কালী কীর্তন থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা। সিনে ক্লাব থেকে নাটকের দলআন্দুলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কম উজ্জ্বল নয়। এক সময় এগুলিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল আন্দুলের সংস্কৃতি চর্চা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতি চর্চার সেই এতিহ্য অনেকটাই ম্লান। যার অন্যতম প্রধান কারণ সাংস্কৃতিক মঞ্চের অভাব।

Advertisement

নুরুল আবসার

শেষ আপডেট: ২০ নভেম্বর ২০১৪ ০১:৩৮
Share:

প্রেমিক মহারাজের দুর্গা ও কালীপুজোর সেই দালান। ছবি: সুব্রত জানা।

কালী কীর্তন থেকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা। সিনে ক্লাব থেকে নাটকের দলআন্দুলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য কম উজ্জ্বল নয়। এক সময় এগুলিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল আন্দুলের সংস্কৃতি চর্চা। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতি চর্চার সেই এতিহ্য অনেকটাই ম্লান। যার অন্যতম প্রধান কারণ সাংস্কৃতিক মঞ্চের অভাব। স্থানীয় সংস্কৃতি কর্মীদের বক্তব্য, যে কোনও বিষয় চর্চার পাশাপাশি তার প্রকাশের দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। অথচ আন্দুলের সংস্কৃতিমনস্ক মানুষের হাজারো দাবি সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত সংস্কৃতি চর্চার কোনও কেন্দ্র গড়ে ওঠেনি শহরে। ফলে বন্ধ হয়ে গিয়েছে সিনে ক্লাব। স্তিমিত নাট্যচর্চা। তবে কালী কীর্তনের ক্ষেত্রে এই সমস্যা হয়নি। কালী কীর্তন এখনও স্বমহিমায় বিরাজমান। কারণ এ ক্ষেত্রে নিজস্ব আখড়া সেই সমস্যা মিটিয়েছে। কিন্তু বন্ধ হয়ে গিয়েছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অধিকাংশ আসর।

Advertisement

আন্দুলের মানুষের দাবি, শিবপুরকে জেলার প্রধান সংস্কৃতি চর্চার কেন্দ্র বলে ধরা হলেও ধারে ও ভারে তাঁদের শহর পাল্লা দিতে পারে শিবপুরের সঙ্গেও। সরস্বতী নদীর ধারে চৌধুরীপাড়া আখড়ার আন্দুল কালী কীর্তন সংস্কৃতি চর্চার একটি প্রধান পীঠস্থান। এর গড়ে ওঠার ইতিহাসটি হল এইরকম। ১৭০ বছর আগে এই এলাকায় জন্মগ্রহণ করেন মহেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। মাত্র ২২ বছর বয়সে কলকাতা সংস্কৃত কলেজ থেকে কবিরত্ন উপাধি পান। পরে তিনি আন্দুল স্কুলে প্রধান সংস্কৃত পণ্ডিতের দায়িত্ব নেন। ঈশ্বর সাধনায় ব্রতী মহেন্দ্রনাথের ‘প্রেমিক মহারাজ’ নামকরণ করেছিলেন ভক্তরা। স্বাধীনতা সংগ্রাম, সমাজসেবা থেকে সংস্কৃতি চর্চা, সবেতেই সমান উৎসাহ ছিল তাঁর। ছিলেন ঘোরতর সংসারীও। তিনিই রচনা করেন কালী কীর্তন। নামে কীর্তন হলেও এই গান গাওয়া হত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধারে। কীর্তনে যেমন খোল ব্যবহার করা হয়। কালী কীর্তনে বাজানো হয় পাখোয়াজ ও তবলা। মৃত্যুর পর প্রতিবছর এখনও নিয়মিত তাঁর বাড়িতে কালী কীর্তনের আসর বসে। দুর্গাপুজো, কালীপুজো, প্রেমিক মহারাজের জন্মদিন পালন প্রভৃতিতে এখানে কালী কীর্তনের আসর বসে। এলাকার মানুষ তো বটেই, দূর-দুরান্ত থেকে অনেকেই আসেন কালী কীর্তন শুনতে। জগৎবল্লভপুরের ডোমজুড়ের বাসিন্দা আশিস বন্দোপাধ্যায় বলেন, “কালী কীর্তনের আসর আমাকে এখানে টেনে আনে।” কালী কীর্তন যেমন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আধারে গাওয়া হয়, আবার শুধুমাত্র শাস্ত্রীয় সঙ্গীত চর্চাতেও এই শহরের যথেষ্ট সুনাম রয়েছে। এখানে ঘরে ঘরে হয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চা। গীতশ্রী, আন্দুল সংগীত সমিতি আয়োজিত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসর বসত সারারাত ধরে। কিন্তু সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। দেশ-বিদেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান করেছেন এমনই একজন শিল্পী কৌশিক ভট্টাচার্য বলেন, “গানের চর্চা, বিশেষত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ আন্দুলে ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি।” তাঁর আক্ষেপ, “শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চর্চায় যেন ভাটার টান দেখা যাচ্ছে।” যদিও কৌশিকবাবু নিজে মণীন্দ্র স্মৃতি সঙ্গীত সংস্থা নামে একটি সংস্থা চালান। একটি স্থায়ী মঞ্চের অভাবের কথা জানিয়েছেন তিনিও।

এ শহরের নাট্যচর্চার ইতিহাসও যথেষ্টই উজ্জ্বল। এক সময়ে পাড়ায় পাড়ায় ছিল নাটকের দল। ষাটের দশকে রাজ্য জুড়ে যে নবনাট্য আন্দোলন হয়েছিল, তার শরিক ছিল আন্দুল। প্রতি বছর অন্তত দু’টি নাট্যোৎসব হত। ছিল ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শাখাও। তাঁরা পাড়ায় পাড়ায় নাটক করতেন। নাটকের দল এখনও রয়েছে, তবে তার সংখ্যা বেশ কম। আর এ জন্য নাট্যপ্রমীরা উপযুক্ত মঞ্চের অভাবকেই দায়ী করেছেন। নাট্যকর্মী সৌরভ চক্রবর্তীর আক্ষেপ, “এমনিতেই নতুন ছেলেমেয়েরা নাটকে আসছেন না। তার উপরে প্রেক্ষাগৃহ নেই। ফলে ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে নাটকের চর্চা।” নাটকের অনুষ্ঠান এখনও হয়। তবে তা জুড়ে গিয়েছে দুর্গাপুজোর সঙ্গে। ভৈরবীচরণ বিদ্যাসাগর প্রতিষ্ঠিত সিদ্ধেশ্বরী মন্দির সংলগ্ন নাট মন্দিরে আন্দুল সর্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি কমিটি প্রতিবছর দুর্গাপুজোর সময়ে নাটকের প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। এ ছাড়া আনন্দমঠ মাঠের দুর্গাপুজোর সময়ে তিনদিনের নাটক প্রতিযোগিতা হয়।

Advertisement

আটের দশকের গোড়ায় গড়ে উঠেছিল সিনে সোসাইটি অফ আন্দুল। ফেডারেশন অফ ফিল্ম সোসাইটি অফ ইন্ডিয়া’র অনুমোদিত আন্দুলের এই সোসাইটির অস্তিত্ব ছিল প্রায় ১০ বছর। সিনেমা দেখানো থেকে সিনেমার উপরে আলোচনা, নিয়মিত ভাবে এ সবের আয়োজন হত। কিন্তু ক্ষয়ের চিহ্ন সেখানেও। বন্ধ হয়ে গিয়েছে সোসাইটি। নিজস্ব প্রেক্ষাগৃহ না থাকায় অন্য প্রেক্ষাগৃহে সিনেমার প্রদশর্ন খরচসাপেক্ষ হওয়ায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে সে সব। সোসাইটির অন্যতম উদ্যোক্তা শিবপদ দাস বলেন, “ফিল্ম ফিনান্স করপোরেশনের আর্থিক সহায়তা নিয়ে আমরা নিজেরাই প্রেক্ষাগৃহ তৈরির চেষ্টা করেছিলাম। নানা কারণে তা হয়নি। প্রেক্ষাগৃহ গড়ার জন্য বহু আন্দোলনও করেছি। তারও নিট ফল শূন্য।” নাট্যচর্চার সঙ্গেও জড়িয়ে ছিলেন প্রবীণ শিবপদবাবু। তিনি বলেন, “এখন যে কয়েকটি নাটকের দল আছে তারা হাওড়া বা কলকাতায় হল ভাড়া নিয়ে নাটক করে। আর প্রতিযোগিতায় ডাক পেলে এলাকার বাইরে গিয়ে নাটক করে আসে।” তাঁর আক্ষেপ, “পুজোর কয়েকদিন নাটক হবে সেই ভরসায় তা আর সারাবছর নাট্যচর্চা হতে পারে না। তাই ফল যা হওয়ার তাই হচ্ছে। শুকিয়ে যাচ্ছে সংস্কৃতির এই সাজানো বাগান।”

(শেষ)

কেমন লাগছে আমার শহর?
আপনার নিজের শহর নিয়ে আরও কিছু বলার থাকলে আমাদের জানান।
ই-মেল পাঠান district@abp.in-এ।
Subject-এ লিখুন ‘আমার শহর আন্দুল’।

অথবা চিঠি পাঠান, ‘আমার শহর’, হাওড়া ও হুগলি বিভাগ, জেলা দফতর,
আনন্দবাজার পত্রিকা, ৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট, কলকাতা- ৭০০০০১

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন