জাল নোটেও জামাতের জাল দেখছে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা

কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎই এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। চমকে উঠলেন গোয়েন্দা অফিসারটি। জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর ওই নথি পরিষ্কার বলছে, বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে ভারতীয় জাল নোট এনে তা এ দেশে ছড়িয়ে দেওয়াটাও তাদের অন্যতম ‘অ্যাজেন্ডা’!

Advertisement

জয়ন্ত ঘোষাল ও সুরবেক বিশ্বাস

নয়াদিল্লি ও কলকাতা শেষ আপডেট: ১৮ ডিসেম্বর ২০১৫ ০৩:১৭
Share:

কাগজপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎই এক জায়গায় চোখ আটকে গেল। চমকে উঠলেন গোয়েন্দা অফিসারটি। জঙ্গি সংগঠন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)-এর ওই নথি পরিষ্কার বলছে, বাংলাদেশ থেকে চোরাপথে ভারতীয় জাল নোট এনে তা এ দেশে ছড়িয়ে দেওয়াটাও তাদের অন্যতম ‘অ্যাজেন্ডা’!

Advertisement

খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্ত-সূত্রেই ওই কাগজপত্র পৌঁছেছিল জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা (এনআইএ)-র এই কর্তার হাতে। এর আগে গোয়েন্দাদের ধারণা ছিল, ভারতের মাটিতে জেএমবি-র উদ্দেশ্য দু’টো। এক, তরুণ-তরুণীদের চরমপন্থায় মগজ ধোলাই ও কয়েকটি মাদ্রাসায় জেহাদি প্রশিক্ষণ দেওয়া। দুই, নাশকতা ঘটানোর জন্য দেশি গ্রেনেড, সকেট বোমার মতো মারণাস্ত্র তৈরি।

কিন্তু জেএমবি যে জাল নোটের জালও ছড়াচ্ছে, খাগড়াগড় তদন্তে তা স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে এনআইএ-র কাছে। ওই বিস্ফোরণ মামলায় ধৃতদের কয়েক জনকে জেরা করেও একই তথ্য জেনেছেন তদন্তকারীরা। এনআইএ সূত্রের খবর, বর্ধমান, নদিয়া, মুর্শিদাবাদ ও বীরভূমে জঙ্গি ডেরা ও ঘাঁটি তৈরি করার খরচের একটা বড় অংশই জেএমবি মিটিয়েছিল বাংলাদেশ থেকে নিয়ে আসা ভারতীয় জাল নোট দিয়ে।

Advertisement

গত ১০ ডিসেম্বর কলকাতায় এসে এনআইএ-র ডিজি শরদ কুমার বলেছিলেন, কয়েকটি মামলার তদন্তে জাল নোটের কারবার ও জঙ্গিদের যোগসূত্র মিলেছে। বস্তুত, খাগড়াগড়ের তদন্ত যখন চলছে, সেই সময়েই পশ্চিমবঙ্গে জাল নোট সংক্রান্ত তিনটি মামলার তদন্ত শুরু করেছিল এনআইএ। এর মধ্যে দু’টির চার্জশিট ইতিমধ্যেই জমা পড়েছে। এই তিনটি তদন্ত চলাকালীনই খাগড়াগড়ের সূত্রে উঠে আসে ভারতীয় জাল নোটের কারবারে জেএমবি-র যোগাযোগের বিষয়টি।

গোয়েন্দাদের হিসেব বলছে, ভারতীয় জাল নোটের ৮০ শতাংশই মূলত ঢোকে মালদহ ও মুর্শিদাবাদ লাগোয়া বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে। খাগড়াগড়ের তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা দেখেছিলেন, মুর্শিদাবাদের যে সব তল্লাট থেকে (বিশেষত রঘুনাথগঞ্জে) জাল নোটের কারবারিরা ধরা পড়েছে, সেই সব এলাকাতেই জাল ছড়িয়েছিল জেএমবি। দুই অপরাধের যোগসূত্র সম্পর্কে এখানেই নিশ্চিত হন তাঁরা। এনআইএ-র আইজি সঞ্জীব সিংহের কথায়, ‘‘এখন এটা পরিষ্কার, ভারতীয় জাল নোট ছড়ানোটাও জেএমবি-র অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। ওই সংগঠনের মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গের সীমান্ত দিয়ে কত জাল নোট ঢুকেছে, তা আমরা খুঁজে বার করার চেষ্টা করছি।’’

জেএমবি-র শিকড় বাংলাদেশে। সেই কারণে খাগড়াগড় বিস্ফোরণের তদন্তে ভারত ও বাংলাদেশের তদন্ত এগিয়েছে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে। ভারতীয় জাল নোটের কারবার দমনেও যৌথ কর্মসূচি হাতে নিয়েছে দু’দেশের সরকার। এই বছর কয়েক দফায় দিল্লি থেকে ঢাকায় গিয়েছে প্রতিনিধিদল। এনআইএ-র তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশের পুলিশ ও গোয়েন্দারা ভারতীয় জাল নোট শনাক্ত করার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। আবার বাংলাদেশের উচ্চপদস্থ গোয়েন্দাদের একটি দল আগামী ২৪ ডিসেম্বর দিল্লি আসছে।

অথচ একটা সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে ভারতে জাল নোট ঢোকা নিয়ে দিল্লির দাবি মানতেই চাইত না ঢাকা। বরং তারা পাল্টা বলত, ভারতের বেশ কিছু সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ ‘ফেন্সিডিল’ কাফ সিরাপ পাচার করা হচ্ছে, যা বাংলাদেশের যুব সমাজের একাংশ ব্যবহার করছে নেশার ওষুধ হিসেবে। ২০০৫-এর অগস্ট মাসে তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী নটবর সিংহের বাংলাদেশ সফরের সময়ে দু’দেশের সচিব পর্যায়ের বৈঠক হয়। সেই বৈঠকে জাল নোটের বিপদের দিকটি জোরালো ভাবে তুলে ধরেছিল ভারত। তখনও বাংলাদেশ আমল দেয়নি। তবে খাগড়াগড় কাণ্ডের পর ছবিটা বদলেছে। ভারত যখন জামাত জঙ্গিদের দমনে তৎপর হয়েছে, তখন জাল নোট দমনের ব্যাপারে বাংলাদেশের সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছে অনেক বেশি।

জাল নোট চক্রের বেশ কয়েক জন পাণ্ডাকে সম্প্রতি ঢাকায় গ্রেফতার করা হয়েছে। ঢাকা বিমানবন্দর ফুট-ওভারব্রিজ তল্লাটে অভিযান চালিয়ে পাচারকারী চক্রের চাঁই আবদুল্লা সেলিম, জাহাঙ্গির ও আবুদল খালেককে গ্রেফতার করেছে বাংলাদেশের পুলিশ। এদের কাছ থেকে ৭০ লক্ষ ভারতীয় টাকার জাল নোট পাওয়া গিয়েছে। আবার বিমানবন্দর থানা এলাকা থেকে কামরুল ইসলাম, আবু সুফিয়ান ও মামুনুর রশিদ নামে তিন জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এই তিন জনের কাছ থেকেও উদ্ধার করা হয়েছে ৩০ লক্ষ টাকার জাল ভারতীয় নোট।

এনআইএ-র দাবি, পশ্চিমবঙ্গের বাংলাদেশ সীমান্ত দিয়ে যে সব জাল নোট ঢুকেছে, সেগুলো এবং জম্মু-কাশ্মীর, পঞ্জাবে উদ্ধার হওয়া জাল নোট একই প্রেসে ছাপা। ভারতীয় গোয়েন্দারা বহু কাল ধরেই বলে আসছেন, পাকিস্তানের একটি সিকিওরিটি প্রেসেই (যেখানে টাকা ছাপা হয়) বেশির ভাগ ভারতীয় জাল নোট ছাপা হচ্ছে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা ইনটেলিজেন্স ব্যুরো-র এক কর্তার কথায়, ‘‘পাক গুপ্তচর সংস্থা আইএসআই জাল নোট ছড়িয়ে ভারতের অর্থনীতির উপর আঘাত হানতে চাইছে।’’

ভারতীয় গোয়েন্দাদের এই দাবির সমর্থন ফের মিলেছে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক একটি ঘটনায়। এক ধৃত জেএমবি নেতা বাংলাদেশ পুলিশের জেরার মুখে পাকিস্তানি দূতাবাসের এক মহিলা কূটনীতিকের সঙ্গে তার যোগসাজশের কথা স্বীকার করেছে। তার দাবি, ভারতে জাল নোট পাচার ও জঙ্গিদের অর্থ জোগানোর কাজ করেন ওই মহিলা। এমন নানা তথ্যই জাল নোট রোখার ক্ষেত্রে বাড়তি অস্ত্র তুলে দিয়েছে ভারতীয় গোয়েন্দাদের হাতে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন