TMC BJP

হিন্দুত্ব থেকে জাতীয়তাবাদ, বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপির নিজস্ব পাঠ্যক্রমেও থাবা বসাতে চাইছে তৃণমূল

পুলওয়ামা পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসবাদে পাকিস্তানের মদত নিয়ে তৃণমূল তেমন কোনও কড়া অবস্থান নেয়নি। কিন্তু পহেলগাঁওয়ের পরে সেই তৃণমূলই সন্ত্রাস এবং জঙ্গি কার্যকলাপে পাকিস্তানের মদত নিয়ে সরব।

Advertisement

শোভন চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ২৩ মে ২০২৫ ১০:২৫
Share:

গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।

নরেন্দ্র মোদীর শাসনে সারা দেশে হিন্দুত্বের রাজনীতি ‘ভিন্ন মাত্রা’ পেয়েছে বলে অনেকেরই অভিমত। জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের সঙ্গে কৌশলে হিন্দুত্বকে মিশিয়ে দেওয়াও গত ১১ বছরে একাধিক সময়ে ঘটেছে। পহেলগাঁওয়ে জঙ্গি হামলা এবং তার পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানকে ‘জবাব’ দিতে ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর ফলে পুনরায় একটি আবহ তৈরি হয়েছে। সেই আবহে বিধানসভা ভোটের এক বছর আগে থেকে বাংলার রাজনীতিতে বিজেপির মৌলিক পাঠ্যক্রমেই থাবা বসাতে চাইছে শাসক তৃণমূল।

Advertisement

আনুষ্ঠানিক ভাবে অবশ্য সে কথা মানছে না তৃণমূল। তা প্রত্যাশিতও নয়। তবে একান্ত আলোচনায় প্রথম সারির নেতাদের অনেকেরই ব্যাখ্যা, লক্ষ্মীর ভান্ডার, কন্যাশ্রীর মতো সরকারি পরিষেবামূলক কর্মসূচির ফলে তৃণমূলের ভিত মজবুত। হিন্দু ভোট এককাট্টা করে বিজেপি সেই ভিতে আঘাত করতে চায়। পদ্মশিবিরের সেই কৌশল মাথায় রেখেই সাংগঠনিক এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির নকশা আঁকা হচ্ছে তৃণমূলের অন্দরে। পাল্টা বিজেপির বক্তব্য, তারা যে ‘বোধ’ নিয়ে হিন্দুত্বের রাজনীতি করে, তা তৃণমূল রপ্ত করতে পারবে না। ফলে পাঠ্যক্রম কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেও তারা সফল হবে না।

২০১৯ সালের লোকসভা ভোটের আগে ১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় সেনা কনভয়ে জঙ্গি হামলায় নিহত হন বহু জওয়ান। সেই ঘটনা নিয়ে জাতীয়তাবাদ এবং দেশপ্রেমের স্রোত বয়ে গিয়েছিল দেশে। ভোটের ফলাফলে স্পষ্ট হয়েছিল, নিজেদের পালে জাতীয়তাবাদী হাওয়া কাড়তে পেরেছিল বিজেপি। ঘটনাপরম্পরা বলে, পুলওয়ামার পরে সন্ত্রাসবাদে পাকিস্তানের মদত নিয়ে তৃণমূল তেমন ‘কড়া’ অবস্থান নেয়নি। কিন্তু পহেলগাঁওয়ের পর সেই তৃণমূলই সন্ত্রাস এবং জঙ্গি কার্যকলাপে পাকিস্তানের মদত নিয়ে সরব হয়েছে। এমনকি, পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে ছিনিয়ে আনাও সময়ের দাবি বলে মন্তব্য করেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়। যিনি আপাতত সন্ত্রাসবাদের নেপথ্যে পাকিস্তানের ভূমিকা তুলে ধরতে বিশ্বমঞ্চে ভারতের প্রতিনিধিদলের অংশ হয়ে জাপান সফরে রয়েছেন। যাবেন আরও চারটি দেশে।

Advertisement

পহেলগাঁও-কান্ড এবং ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর পরে পাকিস্তান সম্পর্কে গোড়া থেকেই তৃণমূল কঠোর অবস্থান নেওয়ায় বিজেপি সরাসরি তৃণমূলের বিরুদ্ধে এমন কোনও ‘ভাষ্য’ তৈরি করতে পারেনি, যাতে জুড়ে থাকতে পারে ‘সংখ্যালঘু তোষণ’ এবং পাকিস্তান। পুলওয়ামার ঘটনার পরে তৃণমূলের প্রথম সারির নেতা-নেত্রীদের অনেকের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে সেই সুযোগ পেয়েছিল পদ্মশিবির। কিন্তু এ বার ছবি বদলেছে। বিজেপি যখন সেনাবাহিনীকে সেলাম জানাতে রাজনৈতিক কর্মসূচির (তিরঙ্গা যাত্রা) ডাক দিয়েছে, তখন তার পাল্টা গত শনি-রবিবার তৃণমূলও পাহাড় থেকে সাগর পর্যন্ত তাদের সংগঠনকে রাস্তায় নামিয়ে দিয়েছে। সেই মিছিলেও হাতে হাতে ছিল জাতীয় পতাকা। অর্থাৎ, উভয় তরফের প্রতিযোগিতামূলক ঝোঁক স্পষ্ট। সেই সূত্রেই মনে করা হচ্ছে যে, জাতীয়তাবাদের আবেগ প্রদর্শনে বিজেপিকে ‘খোলা’ মাঠ দিতে চাইছে না তৃণমূল।

কেন এই পন্থা নিল তৃণমূল, তা নিয়ে শাসক শিবিরের একাংশেও আলোচনা শুরু হয়েছে। আনুষ্ঠানিক না হলেও তার একটি ব্যাখ্যাও শাসক শিবির থেকেই মিলছে।

গত কয়েকটি ভোটে তৃণমূলের কাছে একটি চিত্র পরিষ্কার। তা হল, বিশাল কোনও ওলটপালট না-হলে বাংলার সংখ্যালঘু ভোট তাদের দিকেই থাকবে। পরিপার্শ্ব দেখে অনেকের এ-ও অনুমান যে, তৃণমূলের বন্ধনীর বাইরে যে সংখ্যালঘু ভোট ২০২৪ সালের লোকসভা ভোটেও ছিল, তা-ও একজোট হবে আগামী বিধানসভা ভোটে। কারণ, বাম-কংগ্রেস বাংলার রাজনীতিতে দুর্বলতম জায়গায় পৌঁছেছে।

রাজ্যে মোট ভোটের প্রায় ৩৩ শতাংশ সংখ্যালঘু অংশের। তৃণমূল চায় সংখ্যালঘুদের একচেটিয়া সমর্থন পেতে। নওশাদ সিদ্দিকিদের আইএসএফ গত বিধানসভা ভোটে একটি আসন জিতলেও বহু আসনে ভাল পরিমাণ ভোট পেয়েছিল। আইএসএফের ভোটের মূল ভিত্তি সংখ্যালঘুরাই। আগামী বিধানসভায় তাদের ভূমিকা কী হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। তবে ফুরফুরা শরিফকে কেন্দ্র করে তৃণমূল নতুন করে ‘সক্রিয়তা’ বাড়িয়েছে। দীর্ঘ ৯ বছর পরে গত মার্চে সেখানে গিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্বয়ং। ফুরফুরার এক পিরজাদা কাশেম সিদ্দিকিকে তার পরে একাধিক কর্মসূচিতে মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চে দেখা গিয়েছে। যাকে অনেকেই ফুরফুরা থেকে ‘নতুন মুখ’ তুলে আনার কৌশল বলে অভিহিত করেছেন। সেই সব কর্মকাণ্ড দেখেই অনেকে মনে করছেন, সংখ্যালঘু ভোট এককাট্টা রাখতে তৃণমূল ‘দৌত্য’ শুরু করেছে। অন্য দিকে, বিজেপির লক্ষ্য বাকি ৬৭ শতাংশ হিন্দু ভোটের বেশিরভাগ নিজেদের দিকে টেনে আনা। সেই প্রেক্ষিতেই তৃণমূল চাইছে জাতীয়তাবাদ এবং হিন্দুত্ব নিয়ে বিজেপি-র একার রাজনীতি করে হিন্দু ভোটের ‘মেরুকরণ’ ঠেকাতে।

প্রসঙ্গত, রাজ্যের ৭৪টি আসনের ভোটের ফলাফল পুরোপুরি সংখ্যালঘু ভোট-নির্ভর। আরও ২৫টি আসন রয়েছে যেগুলিতে সংখ্যালঘু ভোট ‘নির্ণায়ক’। তৃণমূলের ধারণা, এই ১০০ আসনের প্রায় সব’কটিতেই তারা নিরঙ্কুশ জয় পাবে। বাকি ১৯৪টি আসনে যাতে হিন্দুভোট একত্রিত না-হয়, আপাতত সেটাই তৃণমূলের কৌশল।

তৃণমূল নেতা কুণাল ঘোষের বক্তব্য, ‘‘বিজেপির স্বাধীনতা সংগ্রামে কোনও ভূমিকা ছিল না। ফলে ওদের দেশপ্রেম আরোপিত এবং মেকি। তাতে ধর্ম মিশে থাকে। হিন্দু জওয়ানের মৃত্যু হলে বিজেপি রাজনীতি করে। কিন্তু ঝন্টু আলি শেখের বেলায় রা কাড়ে না। তৃণমূল তা করে না।’’ পাল্টা রাজ্যসভার বিজেপি সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘তৃণমূল যা করছে, তা দেখে লোকে হাসাহাসি করছে। বিজেপি যে বোধ নিয়ে রাজনীতি করে, তা তৃণমূল রপ্ত করতে পারবে না। আমরা পঞ্চাশের দশক থেকে আমাদের মতাদর্শে অটল রয়েছি।’’

বাংলার রাজনীতিতে বিজেপি যে তাদের রাজনৈতিক অভিমুখকে ক্রমশ ‘জাতীয়বাদ’ থেকে ‘হিন্দু জাতীয়তাবাদ’-এর দিকে নিয়ে যাচ্ছে, তা বিভিন্ন বক্তব্য এবং ঘটনাক্রমে স্পষ্ট। বিশেষত, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর কথাবার্তা, বিবৃতি, প্রতিক্রিয়া সেই ধারণাকে আরও জোরালো করছে। বিজেপির রাজনৈতিক পাঠ্যক্রমের অন্যতম বিষয় ‘মন্দির’ নিয়েও রাজনৈতিক আকচাআকচি চলেছে। দিঘায় নির্মিত জগন্নাথ মন্দির নিয়ে দলগত ভাবে প্রচার করেছে তৃণমূল। আবার তা নিয়ে নানাবিধ সমালোচনা করেছে বিজেপি। বিশেষত শুভেন্দু শিবির (যদিও দিলীপ ঘোষ সস্ত্রীক দিঘায় গিয়ে হাজির হওয়ায় এবং মন্দির নির্মাণ নিয়ে মমতার প্রশংসা করায় বিজেপি-কে খানিকটা পিছনের পায়ে যেতে হয়েছে)। পদ্মশিবিরের সমালোচনাকে হাতিয়ার করে আবার তৃণমূল এই ভাষ্য তৈরির চেষ্টা করেছে যে, মমতার বিরোধিতা করতে গিয়ে বিজেপি মন্দিরেরও বিরোধিতা করছে।

শুধু তা-ই নয়। পাকিস্তানের বিষয়ে দুনিয়াকে জানাতে দেশের প্রতিনিধি হয়ে অভিষেকের বিদেশ সফরকেও জোরদার প্রচারে এনেছে তৃণমূল। অভিষেকের যাওয়া প্রসঙ্গে শুভেন্দু বলেছেন, ‘‘যাঁকে বিদেশে যাওয়ার জন্য হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি নিতে হয়, যাঁর পাসপোর্ট জমা থাকে ইডি-র কাছে, তিনি দেশের প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না।’’ তৃণমূল সেই বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলতে শুরু করেছে, অভিষেকের বিরোধিতা করতে গিয়ে শুভেন্দু দেশের প্রতিনিধিত্বকেও অস্বীকার করছেন। যেমন মমতার বিরোধিতা করতে গিয়ে দিঘার মন্দিরকে অসম্মান করেছেন তিনি।

এ সবই ভাষ্যের পাল্টা ভাষ্য তৈরির রাজনৈতিক অনুশীলন। কিন্তু এর বাইরেও সার্বিক ভাবে বঙ্গ রাজনীতিতে নানাবিধ বাস্তবতার কথাও আলোচিত হচ্ছে। যার অন্যতম তৃণমূল সম্পর্কে ‘সংখ্যালঘুদের প্রতি নরম’ মনোভাবের প্রচার এবং সেই আঙ্গিকেই মুর্শিদাবাদের হিংসার ঘটনাকে দেখা। সে সব ঘটনাবলি বৃহদংশের হিন্দু জনতার স্মৃতিতে এখনও দগদগে বলে মেনেও নিচ্ছেন তৃণমূলের প্রথম সারির নেতারা। মানছেন, ওই ঘটনা বাংলার শাসকদলের কাছে ‘ক্ষত’।

সেই ‘ক্ষতে’ প্রলেপ দিতেই কি বিজেপির পাঠ্যক্রমে থাবা? সরাসরি জবাব না দিলেও কর্মসূচি এবং প্রচারের ধরনে স্পষ্ট, বিজেপি নামক বাঘের ঘরে ঘোগ হয়ে বাসা বানাতে নেমেছে তৃণমূল।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement
Advertisement