Jhargram

জঙ্গলমহলের পুজোয় লোকায়ত দুর্গা দর্শন

জঙ্গলমহলের লোকায়ত শারদোৎসবে বৈভব নেই। তবে বাগদি, শবর ও প্রান্তিক মানুষের দেবী-আরাধনায় রয়েছে হৃদয়ের আকুতি।

Advertisement

কিংশুক গুপ্ত

ঝাড়গ্রাম শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২২ ০৭:১২
Share:

বেলিয়াবেড়ার ভোল গ্রামে কয়েকশো বছরের পুরনো বর্গি দমনের দু'টি তরবারিকেই দেবী জ্ঞানে পুজো করা হয়। ফাইল চিত্র

কোথাও দেবী অস্ত্ররূপে পূজিতা, কোথাও মাটির হাতি-ঘোড়ার ‘ছলনে’ই আরাধনা, কোথাও আবার পূর্বপুরুষের স্মৃতিতে শোকযাপন।

Advertisement

জঙ্গলমহলের লোকায়ত শারদোৎসবে বৈভব নেই। তবে বাগদি, শবর ও প্রান্তিক মানুষের দেবী-আরাধনায় রয়েছে হৃদয়ের আকুতি। এ বার পুজোর পর্যটনে ঝাড়গ্রাম জেলার সেই সব লোকায়ত দুর্গাপুজো দেখার সুযোগ পাবেন পর্যটকেরা। পুজোর মধ্যে বেড়াতে এলে পরিক্রমার প্যাকেজে থাকবে বাছাই করা সাবেক লৌকিক দেবীর পুজো দেখার সুযোগ। তবে সে ক্ষেত্রে টুর প্যাকেজে জেলার অন্য দর্শনীয় স্থান দেখার সুযোগ আর থাকবে না।

পুজোর গন্ধমাখা এই পর্যটন প্যাকেজে সাড়াও মিলছে। চলছে অগ্রিম বুকিং। পর্যটন দফতর স্বীকৃত ‘ঝাড়গ্রাম টুরিজ়ম’-এর কর্তা সুমিত দত্ত বলছেন, ‘‘বেশ কিছু পর্যটক লৌকিক দুর্গার থানগুলি দেখতে অগ্রিম বুকিং করেছেন। তবে ওই সব পুজো ঘুরিয়ে দেখানোয় সময়াভাবে অন্য দর্শনীয় স্থানগুলি প্যাকেজে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।’’ থাকা-খাওয়া ও গাড়িতে পুজো দেখা নিয়ে দু’রাত তিনদিনের প্যাকেজে জনপ্রতি খরচ সাড়ে ৫৯৯০ টাকা। তবে ন্যূনতম চারজন থাকতে হবে।

Advertisement

ঝাড়গ্রাম জুড়ে রয়েছে দুর্গার নানা লৌকিক রূপ। বেলিয়াবেড়ার বালিপাল গ্রামে যেমন স্তূপাকার পোড়ামাটির হাতি-ঘোড়াতেই দুর্গার আরাধনা করেন বাগদি সম্প্রদায়ের ‘দেহুরি’ (পূজারি)। স্বপ্নাদেশে কেঁদুগাছের জঙ্গলে পুজো শুরু হয়েছিল বলে দেবীর এখানে ‘কেঁদুয়া বুড়ি’। আজও দেহুরি নিজের রক্ত নিবেদন করেন দেবীকে। মেদিনীপুরের লোক সংস্কৃতি গবেষক মধুপ দে বলছেন, ‘‘জনশ্রুতি, বর্গি হামলার সময় স্থানীয়রা বীরত্বের সঙ্গে লড়েছিলেন। অনেকে মারাও যান। পূর্বপুরুষদের স্মৃতিতেই রক্তাঞ্জলির এই উপাচার।’’

জামবনির সানগ্রাম ও যুগিবাঁধ গ্রাম লাগোয়া শালবীথির মাঝেও পোড়া মাটির হাতিঘোড়ায় প্রতীকী ভাবে ‘দুর্গাবুড়ি’ পূজিত হন। জনশ্রুতি, এখন যেখানে চিল্কিগড়ের কনকদুর্গা মন্দির, আড়াইশো বছর আগে সেখানেই ছিল শবরদের বাসভূমি। জামবনি পরগনার সামন্ত রাজা গোপীনাথ সিংহ মত্তগজ মন্দির নির্মাণ করলে শবররা সরে গিয়ে সানগ্রামের কাছে গহীন জঙ্গলে ঘর বাঁধেন। তাঁদের ‘গরামদেবী’ (গ্রামের দেবী) দুর্গাবুড়ি স্থাপিত হন সেখানেই।

বেলিয়াবেড়ার ভোল গ্রামে দেবী ‘অস্ত্ররূপেণ সংস্থিতা’। বাগদিদের ওই গ্রামে একজোড়া প্রাচীন তরবারিকেই দুর্গারূপে পুজো করা হয়। মেলাও বসে। সাঁকরাইলের তালাই গ্রাম লাগোয়া জয়চণ্ডীর মন্দিরে শিলাময়ী দেবীর পুজো সারা বছর শবর ‘দেহুরি’ করলেও শারদীয়া দুর্গাপুজোয় সে দায়িত্ব পালন করেন ব্রাহ্মণ। শবরেরা কেবল বলিদানের দায়িত্বে থাকেন।

বিজয়ার দশমীর আচারেও রয়েছে জঙ্গলমহলের নিজস্ব ছোঁয়া। দুর্গার শোকে প্রতীকী বাদ্যযন্ত্র ভূয়াং বাজিয়ে ‘দাঁশায়’ নাচ নাচেন সাঁওতাল পুরুষেরা। সাঁওতাল পুরাকথা মতে, আশ্বিনের শুক্লপক্ষের দশমী তিথিতে ‘হুদুড় দুর্গা’ নামে পরাক্রমী এক মূলবাসী রাজাকে বধ করেছিলেন এক আর্যনারী। সেই থেকে দশমী হল শোক-যাপনের দিন। গানের কথায়-সুরেও তাই থাকে ‘হায়রে হায়রে’ বিলাপ।

এই সব পুজো দেখতে আগ্রহী পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা হয়েছে গ্রামীণ হোম স্টেতে। সব মিলিয়ে লোভনীয় এই প্যাকেজ। বারাসতের মিতা বিশ্বাস, জগদ্দলের অমিতাভ রায়রা বলছেন, ‘‘একটু অন্যরকম ভাবে পুজো দেখব বলেই অগ্রিম বুকিং করেছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন