‘মনের কথা’য় বিশ্বাস রেখে সংসার পাতছেন মূক-বধির রাজা-তিন্নি

নিস্তব্ধতা আটকাতেও পারেনি মনের টান। কৃষ্ণনগরের রাজা (অরিত্র ঘোষ) আর রাজারহাটের তিন্নির (ইতিকা বিশ্বাস) একে-অপরকে চিনে নিতে অসুবিধে হয়নি।

Advertisement

সুচন্দ্রা ঘটক

কলকাতা শেষ আপডেট: ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০২:৩৪
Share:

একসঙ্গে: অরিত্র-ইতিকা।

মুখের কথা নয়, মনের কথায় বিশ্বাস রেখেছেন তাঁরা। ঠিক করে রেখেছিলেন জীবনসঙ্গী হবেন এমন কেউ, যিনি কথা বলতে পারেন না নিজেও।

Advertisement

নিস্তব্ধতা আটকাতেও পারেনি মনের টান। কৃষ্ণনগরের রাজা (অরিত্র ঘোষ) আর রাজারহাটের তিন্নির (ইতিকা বিশ্বাস) একে-অপরকে চিনে নিতে অসুবিধে হয়নি। মনের কথা প্রকাশ করতে গতানুগতিক ভাষা ব্যবহারের প্রয়োজন পড়েনি তাঁদের। আজ, শনিবার রাজারহাটে বসছে তাঁদের বিয়ের আসর। কনে একুশ বছরের তিন্নি, কানে শুনতে পান না ছোটবেলা থেকেই। কথাও অস্পষ্ট। বর, বছর পঁচিশের রাজা, বলতে-শুনতে পারেন না একেবারেই। তবে ঘর বাঁধার স্বপ্নের কাছে এই প্রতিবন্ধকতা কোনও বাধাই নয় বলে মনে করেন তাঁরা। বরং বাড়ির সকলকে জানিয়েছেন, এতেই স্বস্তি ওঁদের।

বছর খানেক আগে ফেসবুকে মূক-বধির সদস্যদের একটি গ্রুপে মেক্যানিকাল ইঞ্জিনিয়ার রাজার সঙ্গে আলাপ হয় ডিরোজিয়ো কলেজের স্নাতক স্তরের ছাত্রী তিন্নির। ভাললাগা বাড়তে থাকায় নিউ টাউনের একটি শপিং মলে গিয়ে প্রথম সাক্ষাৎ। ধীরে ধীরে ভরসা গাঢ় হয়ে এ বার সংসার বাঁধতে চলেছেন সেই যুগল।

Advertisement

আরও পড়ুন: আজ ‘ঠান্ডা’ শিলংয়ে প্রশ্ন রাজীবকে​

প্রথম দেখার পরেই তিন্নি নতুন পাওয়া বন্ধুর কথা জানান নিজের যমজ বোন অঙ্কিতা বিশ্বাসকে। শুক্রবার অঙ্কিতা জানালেন, এমনিতে বোনকে বিশেষ চোখের আড়াল করেন না ওঁরা। বোনের বিশেষ বন্ধুর কথা জানতে তাই নিজেই রাজার সঙ্গে যোগাযোগ করে আলাপ করেন। একসঙ্গে নানা জায়গায় ঘুরতে যাওয়া তার পরে।

আরও পড়ুন: বই ফেলে দেয় বাবা, পড়তে চেয়ে বাড়ি ছাড়ল কিশোরী

রাজার বাড়ি থেকে জানতে পারায় প্রথম ফোনটা আসে বিশ্বাস বাড়িতে গত বছরের এক সময়ে। কৃষ্ণনগরের দুই স্কুলশিক্ষক শ্যামলী ঘোষ আর অর্ধেন্দু ঘোষের ছেলে রাজা বান্ধবীর কথা প্রথমে জানিয়েছিলেন মাকেই। শুক্রবার বিয়ের ব্যস্ততার মাঝেই শ্যামলী বলেন, ‘‘ছেলে আগেই বলেছিল, এমন কাউকে বিয়েই করবে না, যে কথা বলতে পারে। আমাদের তাতে কোনও আপত্তিও ছিল না। হবু বৌমার সঙ্গে তো ইতিমধ্যেই হোয়াটসঅ্যাপে লিখে লিখে কথাবার্তা বলি। ভাব হয়ে গিয়েছে ভালই।’’

রাজার মামা অভিজিৎ বিশ্বাস জানালেন, ছোট থেকেই সব রকম মানুষের মাঝে বড় করা হয়েছে রাজাকে। কখনও তাঁকে আলাদা ভাবে থাকতে দেননি বাবা-মা। পড়াশোনা থেকে হাতের কাজ, সবেতেই সমান উৎসাহ এই তরুণের। বাবা অর্ধেন্দুবাবুর ইচ্ছায় পঞ্চম শ্রেণিতে মূক ও বধির শিশুদের বিশেষ স্কুল ছাড়িয়ে সাধারণ স্কুলে ভর্তি করা হয় তাঁকে। ছেলেও প্রমাণ করে দেন, প্রতিবন্ধকতা পিছিয়ে রাখতে পারবে না তাঁকে। সব কাজেই এগিয়ে গিয়েছেন উৎসাহ নিয়ে। এমনকি, দুই বাড়ির মেনু কার্ড থেকে বধূবরণের কার্ড, সব কিছু রাজা নিজের হাতেই ডিজাইন করেছেন বলে জানান অঙ্কিতা।

তিন্নিও তেমনই। হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক থেকে পড়াশোনা— চারপাশের সঙ্গে এ সবের মাধ্যমে যোগাযোগ রেখে চলতেই ভালবাসেন তিনি। কথার অস্পষ্টতা জয় করে দিব্যি বাড়ির সকলকে জানিয়ে দিচ্ছেন কোথাকার শাড়ি, কোন গয়না পছন্দ। বোনের বিয়ের আগের দুপুরে অঙ্কিতা জানালেন, সংসার নিয়ে অনেক স্বপ্নের কথা গোপনে জানিয়েছেন বোনকে।

তবে সকলের মধ্যে থেকেও সব সময়েই এমন কাউকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতে চেয়েছেন তিন্নি, যিনি কথা বলতে পারেন না। তবে সত্যিই যে এমন মনের মতো পাত্র পাওয়া যাবে, সে বিষয়ে বেশি আশাবাদী ছিল না পরিবার। চিন্তা থাকতই বাড়ির ছোট মেয়েকে নিয়ে। ওঁর ইচ্ছেপূরণ হতে দেখে এখন অবশ্য বেজায় খুশি বাবা-মা অলককুমার বিশ্বাস এবং বুলবুল বিশ্বাসও। তাঁরা জানিয়েছেন, মেয়ের মনের মতো বর পাচ্ছে, এর চেয়ে বেশি আর কী বা চাইতে পারেন?

কিন্তু দু’জনেই কথা বলতে-শুনতে না পারলে পথ চলায় সমস্যা বাড়বে না তো? আশাবাদী রাজা আর তিন্নি। পরিজনেদের জানিয়ে দিয়েছেন, প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে চলতে শেখাই ওঁদের সঙ্কল্প। ‘খামোশি’ ছবিতে নানা পটেকর-সীমা বিশ্বাসের সংসার তো অনেকটা তেমনই ছিল!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন