ঘরে ভরা সংসার, এটা কিন্তু পুলিশ কিয়স্ক

স্বভূমির মোড়ে, ই এম বাইপাসে ডিভাইডারের উপরে নীল-সাদা পুলিশ চৌকি। আগে এখান থেকেই যান নিয়ন্ত্রণ করা হত। পুলিশের লাঠি, হেলমেট, আলো থাকত সেখানেই।

Advertisement

নীলোৎপল বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ১৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০০:৫৬
Share:

ঘরকন্না: কিয়স্কের ভিতরে-বাইরে এ ভাবেই বসবাস ভাবীর। ছবি: স্নেহাশিস ভট্টাচার্য

স্বভূমির মোড়ে, ই এম বাইপাসে ডিভাইডারের উপরে নীল-সাদা পুলিশ চৌকি। আগে এখান থেকেই যান নিয়ন্ত্রণ করা হত। পুলিশের লাঠি, হেলমেট, আলো থাকত সেখানেই।

Advertisement

এক দুপুরে রাস্তা খুঁজে হন্যে হয়ে এক যুবক চৌকির সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘কেউ আছেন? বেলেঘাটার অটো কোন দিক থেকে পাব?’’ কম্বল এবং চাদরে ঢাকা গেটের ভিতর থেকে জবাব এল, ‘‘আগিয়ে যান। পুলিশ নেই। এখন এখানে ভাবী থাকে!’’

সীমা সিংহ ওরফে ভাবী। বিধাননগর দক্ষিণ থানার পুলিশ চৌকিতে তাঁরই সংসার। স্থানীয়েরা জানাচ্ছেন, বছরখানেক আগে ভাবীকে চৌকিটি ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। ফুটপাতের দোকানে কাজ করে এবং দত্তাবাদ এলাকার বাসিন্দাদের দেওয়া খাবারে দিন কাটে তাঁর।

Advertisement

এক দুপুরে গিয়ে দেখা গেল, পুলিশ-চৌকির সংসারে রান্নার ব্যবস্থাও রেখেছেন ভাবী। চৌকির ভিতরে মুখোমুখি দু’টি সিমেন্টের স্ল্যাব। কোনও কালে পুলিশের বসার জন্য তৈরি করা হয়েছিল। তার মধ্যেই উনুন জ্বালানোর ব্যবস্থা। স্ল্যাবের একটি দেখে মনে হয়, সেটি ভাবীর খাট। টানটান করে পাতা লাল চাদরের নীচে মোটা কম্বল। উল্টো দিকের স্ল্যাব সম্ভবত তাঁর খাওয়ার টেবিল। তাতে বাসনপত্রের পাশাপাশি বিভিন্ন দেব-দেবীর ছবি বসানো। ওই স্ল্যাবের নীচেই থরে থরে সাজানো রান্নার মশলার কৌটো। এক কোণে রয়েছে রুটি করার বেলন-চাকি। চৌকির দেওয়ালের নীল-সাদা রং এখন ফিকে হয়ে এসেছে। দেওয়াল জুড়ে দেব-দেবীর ছবির পাশাপাশি আলতা দিয়ে হিন্দিতে লেখা বিভিন্ন মন্ত্র।

ঘরে উঁকিঝুঁকি দেখে এ বার ভিতর থেকে ঝাঁঝিয়ে উঠলেন ভাবী। বললেন, ‘‘পুলিশের লোক নাকি? এটা তো আমায় লিখে দিয়েছেন। আবার কী চাই?’’ পুলিশের লোক নয় জেনে আশ্বস্ত হয়ে শুরু করলেন নিজের গল্প। দাবি করলেন, তাঁর বাড়ি আদতে লখনউয়ে। বয়স পঞ্চান্ন হবে! পছন্দ করে পাড়ার ছেলেকে বিয়ে করেছিলেন। বছর দশেক আগে মারা গিয়েছেন স্বামী। ছেলে-মেয়ে কেউ দেখেননি। কিন্তু কলকাতায় এলেন কী ভাবে? প্রশ্ন শুনে সামান্য উদাসীন ভাবী। ফিরে গেলেন পুলিশ তাড়ানোর গল্পে। এ বার স্পষ্ট হিন্দিতে বললেন, ‘‘পুলিশ কাজের কাজ করত না। তাই তাড়িয়ে দিয়েছি। আমিই এই ঘরের সব। এই ঘর ভাড়া নিতে হলে আমার সঙ্গেই কথা বলতে হবে।’’

ভাবীর খোঁজ নিতে দেখে চৌকির সামনের ভিড় থেকে লক্ষ্মী বাগ নামে এক মহিলা বললেন, ‘‘মাথার সমস্যা আছে। এক রাতে ঠান্ডায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন, পুলিশ উদ্ধার করে চৌকিতে থাকতে দেয়। এখানেই রয়ে গিয়েছেন। আমরা যা পারি খেতে দিই।’’ বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের ডিসি (সদর) অমিত জাভালগি বলছেন, ‘‘চৌকিতে কোনও সাধারণ মানুষ ও ভাবে থাকতে পারেন না। আমরা নিশ্চয় ওই মহিলাকে সাহায্য করব, কোনও হোমে থাকার ব্যবস্থা করে যায় কি না, তা দেখব।’’ চৌকিটি বিধাননগর দক্ষিণ থানা এলাকার অন্তর্ভুক্ত। সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত আধিকারিক অবশ্য বললেন, ‘‘কোথায় যাবেন উনি? তাই চৌকিটি ওঁকে ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের সমস্যা হয় না।’’ সেই সঙ্গে ওই আধিকারিকের বক্তব্য, ‘‘ওঁর সব ভাল। খালি রাতবিরেতে মাঝে মধ্যেই স্নান করেন।’’

বারবার স্নান করেন কেন? পুলিশ চৌকির গেট আগলে ভাবী বলেন, ‘‘আমার ইচ্ছে। দিনে ১০০ বার করব। থাকতে দিয়েছে বলে যা খুশি বলবে?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন