নিজস্ব চিত্র।
শহর জুড়ে যেন আলোর মরসুম। সেই আলো মেখে দিনভর কালীপুজোর উৎসবে সামিল হল নগরবাসী। আলোর সাজে আর আতসবাজির বাহারে উত্তর কলকাতার সঙ্গে পাল্লা দিল দক্ষিণও। তবে সকলকে টেক্কা দিয়ে প্রতি বছরের মতো এ বারও জমাটি কালীপুজোর আখর হয়ে উঠেছে বারাসত-মধ্যমগ্রাম এলাকা। চোখে পড়ার মতো ভিড় টেনেছে হাওড়াও।
কলকাতা শহরের পারিবারিক পুজোগুলির মধ্যে অন্যতম উত্তর কলকাতার হেদুয়ায় দত্তবাড়ির পুজোয় মূল আকর্ষণ ছিল ফানুস। বিশেষ ভাবে বানানো বিশালাকৃতির একাধিক ফানুস উড়ল বাড়ির খুদে সদস্যদের হাত ধরে। লাল-নীল-সবুজ-হলুদ রঙের উজ্জ্বল ফানুসগুলি কালীপুজোর বিকেলে আলোর বার্তা নিয়ে উড়ে গেল আকাশে।
উত্তর কলকাতার বড় বড় মণ্ডপগুলির সামনের রাস্তা জুড়ে মেলার মতো পসরা আরও এক বার মনে করিয়ে দেয় সদ্য-ফুরনো দুর্গাপুজোর রেশ। রাজা রামমোহন সরণি অর্থাৎ, আমহার্স্ট স্ট্রিটে ঢুকতেই চোখে পড়ে সারি সারি আলোর মালায় সাজানো রাস্তার দু’পাশ। ৭৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্ল্যাটিনাম জুবিলি পালন করছে আমহার্স্ট স্ট্রিট সর্বজনীন। সুউচ্চ মঞ্চের কালীমূর্তির বিশালতা প্রায় দুর্গামূর্তির মতোই।
পাশেই কেশবচন্দ্র সেন স্ট্রিটের নব যুবক সঙ্ঘের পুজো, যা ফাটাকেষ্টর পুজো বলেই বেশি পরিচিত। ভিড় সামলাতে রাস্তা জুড়ে ব্যারিকেড করে রেখেছেন রক্ষীরা। মণ্ডপে পৌঁছনোর রাস্তা জুড়ে মাটির পুতুল থেকে স্টিলের বাসন, বেনারসী পান থেকে হাতে আঁকার মেহন্দি— বাদ নেই কোনও পসরা। প্রায় মেলার আবহে হাঁটতে হাঁটতে মণ্ডপে পৌঁছতে গেলে চোখে পড়ে ক্যামেরা হাতের বিদেশিনিদের ভিড়। জার্মান তরুণী সুজেন ক্যারল বললেন, ‘‘কলকাতার কালীপুজোর কথা শুনেছি বহু বার। আলাদা রং আছে, আনন্দ আছে। এ বার দেখছি, আলোর উৎসবে কেমন করে মেতে ওঠে ‘সিটি অব জয়’।’’
ফুলের আর আলোর সাজে, থরে থরে সাজানো মিষ্টির বাক্সে প্রতিটা দোকানে উৎসবের মেজাজ বিপিনবিহারী গাঙ্গুলি স্ট্রিটে। সংলগ্ন নবীনচাঁদ বড়াল লেনের পল্লিকল্যাণ সমিতির পুজোয় মায়ের গা-ভরা সোনার গয়না। সোনার গয়না ও রুপোর মুকুটে সেজে উঠেছে মধ্য কলকাতার কোলে মার্কেটের বিপরীতে ফরডাইস লেনের পুজোও।
আর এত আয়োজনের পাশাপাশিই নতুন কিন্তু সাবেক সাজে মায়ের আরাধনা চলেছে ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি আর ঠনঠনিয়া কালীবাড়িতে। এ ছাড়াও শহরের পথের পাশের বিভিন্ন ছোট ছোট কালী মন্দিরে আজ পুজো উপলক্ষে মায়ের নতুন শাড়ি, রঙিন ফুলমালার সাজ, মোম-প্রদীপের স্নিগ্ধ প্রসাধন যেন মন ভাল করে দেয়।
উত্তরের সঙ্গে পাল্লা দিয়েই রকমারি টুনির আলোয় সেজেছে দক্ষিণ কলকাতার ভবানীপুর-কালীঘাট-চেতলা এলাকা। চেতলার অগ্রণী সঙ্ঘে ফিরহাদ ববি হাকিমের পুজো দেখতে মানুষের ঢল। উল্টো দিকের কালীঘাটে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ির পুজোয় দিনভর আনাগোনা করেছেন নেতা-মন্ত্রী থেকে বিভিন্ন সেলিব্রিটিরা। নিরাপত্তার নিয়ম মেনে সাধারণ মানুষও ঢুকেছেন দলে দলে।
যাদবপুর-বাঘা যতীন এলাকার ভিড় মনে করিয়ে দেয়, বাঙালি জাতি আদপেই হুজুগপ্রিয়। নতুন পোশাকে মানুষের ঢল নেমেছে পথ জুড়ে। চলছে মণ্ডপে মণ্ডপে ঘোরা, খাওয়া, আড্ডা। উজ্জ্বল আলো মেখে এক ঝাঁক জেন ওয়াইয়ের প্রতিনিধি পৌলমী, আকাশ, সৌমি, সুদীপ্তরা বললেন, দুর্গাপুজো ফুরোতেই শুরু হয় মন খারাপের পালা, ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস ফেলতে থাকে পরীক্ষা। সেই চাপের মধ্যে যেন এক টুকরো আনন্দের আলো নিয়ে আসে এই কালীপুজো। ঠাকুর দেখা শেষ করে, সারা রাত আতসবাজি পোড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে, কলকল করতে করতে ভিড়ের মধ্যে দিয়ে মিলিয়ে গেল দলটা।
শহরের পাশে কালীপুজোর মূল আকর্ষণস্থল বারাসতে কিন্তু সব পুজোর উদ্বোধন হয়ে গিয়েছে শুক্রবারই। বারাসত স্টেশনের পাশেই নেমে এসেছে নায়াগ্রা ফলস! দশ বিঘা এলাকা জুড়ে পুকুরের উপরে ঝরে পড়া দুর্দম জলরাশি যে নায়াগ্রা নয়, তা ভাবতে একটু কষ্টই হয়। সে রকম নবপল্লি এলাকায় ঢুকলেই মানুষের মনে হতে বাধ্য, যেন ভ্যাটিক্যান সিটিতে পৌঁছে গিয়েছেন। এ রকমই নানা থিমে আর চোখ ধাঁধানো আলোয় সেজে ওঠা শহরে সারা শহর তো বটেই, রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তের সাধারণ মানুষ থেকে সেলিব্রিটির দল ভিড় জমিয়েছেন বারাসতের আনাচকানাচে। আলোকময় পথঘাট জুড়ে কেবলই জনসমুদ্র।
যানজট এড়াতে এবং অপ্রীতিকর ঘটনা রুখতে বিভিন্ন মণ্ডপের সামনের রাস্তাগুলিতে যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ টানা হয়েছে। পর্যাপ্ত সংখ্যায় পুলিশকর্মী মোতায়েন রয়েছেন বিভিন্ন এলাকায়। এ বছর প্রথম বারাসত কালীপুজোর জন্য বিশেষ অ্যাপ তৈরি হয়েছে। ভিড়ে ভিড়াক্কার বারাসতের নানা মণ্ডপের হাল-হদিস দিতে এবং পথঘাটের সহজ দিশা দিতে বেশ জনপ্রিয় হয়েছে অ্যাপটি।
শহর কলকাতা আর বারাসতের পাশাপাশিই, কালীপুজোর জমকে পিছনে রাখা যায় না হাওড়াকে। কোথাও তৈরি হয়েছে নাট মন্দির, কোথাও বা গা ছমছমে গুহার ভিতর কালীপ্রতিমা। কোথাও আবার পাহাড়ি পথে বরফের গুহায় চামুণ্ডা মূর্তি। এ বার কালীপুজোয় হাওড়ার বালি থেকে বটানিক্যাল গার্ডেন, মধ্য থেকে দক্ষিণ সর্বত্র নানা থিমের ছড়াছড়ি। তা দেখতেই শনিবার সন্ধ্যা থেকে হাওড়ার বিভিন্ন রাস্তায় দর্শনার্থীদের ভিড় ছিল চোখে পড়ার মতোই। আইন-শৃঙ্খলা সামলাতে রাখা ছিল পর্যাপ্ত পুলিশি ব্যবস্থাও।
হাওড়া পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত কালীপুজোর সংখ্যা প্রায় ৩৫০। এত পুজোর মধ্যে বড় বাজেটের পুজো হয় মূলত মধ্য হাওড়ার ব্যাঁটরা ও দাশনগর থানা এলাকায়। ভিড়ও বেশি ওই এলাকার মণ্ডপগুলিতে। এ দিন ওই দু’টি এলাকার সানপুর মিতালী সঙ্ঘ, বিজলী বালক সঙ্ঘ, ছাতিমতলা বালক সঙ্ঘ, মধ্য বৃন্দাবন যুবকবৃন্দের মণ্ডপে সন্ধ্যা থেকেই দর্শনার্থীদের ভিড় জমতে শুরু করে। শুধু মণ্ডপের বৈচিত্রে নয়, ওই এলাকায় পুজো মণ্ডপগুলির আলোকসজ্জা দেখতে প্রতি বছরের মতোই শহর ও শহরতলি থেকে দর্শনার্থী এসেছেন। মধ্য হাওড়া ছাড়াও এ দিন ধাড়সার ইয়ুথ অ্যাসোসিয়েশন, দেবীর পাড়া নতুন দল, রথতলা মহামানব সঙ্ঘের মণ্ডপে থিম দেখতে ভিড় উপচে পড়ে।
হাওড়া সিটি পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, শব্দবাজির দৌরাত্ম্য ও শহরে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সামলাতে এ দিন শহরে মোতায়েন ছিল প্রায় দেড় হাজার পুলিশ। রাস্তায় উপস্থিত ছিলেন হাওড়া সিটি পুলিশের পদস্থ কর্তারাও। কোনও রকম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেই তৎক্ষণাৎ ঘটনাস্থলে পৌঁছনোর জন্য প্রস্তুত ছিল এইচআরএফএস ও আরএফএস-এর আটটি গাড়িও।
সব মিলিয়ে আলোর জমকে মেতে ওঠা শহরে এখনও ফুরোয়নি উৎসবের আবহ। প্রায় দুর্গাপুজোর সমান উন্মাদনাতেই ফের আনন্দে সামিল হতে পথে নেমেছে মানুষ।