Coronavirus

বিদেশ-যোগ নিয়ে সন্দেহে পড়শির চোখেও এখন অবিশ্বাস

উল্টোডাঙার আবাসনে আমস্টারডম-ফেরত মহিলা বৃদ্ধা মাকে নিয়ে গুয়াহাটি গিয়েছিলেন বলেও পড়শিরা সরব।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ২২ মার্চ ২০২০ ০৫:০২
Share:

বারান্দায় দাঁড়িয়ে গৃহবন্দি ইতালীয়দের গান গাওয়ার ছবি মন জয় করলেও এ শহরে বারান্দায় দাঁড়ালে তৈরি হচ্ছে আতঙ্ক। ছবি: রণজিৎ নন্দী

রাজ্যের এক আইপিএস-কর্তার পুত্র, সদ্য আমেরিকা-ফেরত তরুণের বিরুদ্ধে বাড়ি থেকে বেরোনোর অভিযোগ উঠেছিল শনিবার সকালে। পরিজনেরা সে অভিযোগ মানতে না-চাইলেও সন্ধ্যায় কোয়রান্টিন কেন্দ্রে পাঠানো হল তাঁকে। বিদেশ-ফেরত নাগরিকদের সংস্রবে আসা নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় এখন এতটাই আতঙ্কের আবহ!

Advertisement

সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের একটি বহুতলে সিঁড়ির রেলিং ব্লিচিং গুঁড়োয় সাফসুতরো করা হচ্ছে বারবার। এগারোতলার ফ্ল্যাটে দিন তিনেক আগে আমেরিকা থেকে ফিরেছেন শহরের এক পুরকর্তার কন্যা। বহুতলের বাসিন্দাদের আতঙ্ক, ওই তরুণী ফ্ল্যাটে ঢোকার পরে না বেরোলেও তাঁর বাবা লিফট ব্যবহার করছেন এবং চালক-সহ গাড়ি নিয়ে বেরোচ্ছেন। ওই বাড়িতে পরিচারিকারাও ঢুকছেন। বিষয়টি কাউন্সিলর-থানা অবধি গড়িয়েছে।

উল্টোডাঙার আবাসনে আমস্টারডম-ফেরত মহিলা বৃদ্ধা মাকে নিয়ে গুয়াহাটি গিয়েছিলেন বলেও পড়শিরা সরব। কাউন্সিলর শান্তি কুণ্ডুর মধ্যস্থতায় তাঁরা গৃহবন্দি থাকার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। কিছু দিন গাড়িচালক বা পরিচারিকা, কারও সঙ্গেই সংস্রব রাখবেন না। রামগড়ের আমেরিকা-ফেরত তরুণকে নিয়েও পড়শিরা আতঙ্কে। কলকাতায় চার করোনা আক্রান্তের তিন জনেরই বিদেশ-যোগ জানাজানি হওয়ার পরে এখন শহরের বিভিন্ন পাড়াতেই আতঙ্ক ও অন্তহীন প্রশ্ন। চেনা পড়শির সঙ্গে সম্পর্কও যেন পাল্টে যাচ্ছে।

Advertisement

কাঁকুড়গাছিতে সদ্য বিদেশ-ফেরত এক ব্যক্তিকে ঘিরে পড়শিদের অভিযোগ শুনে খোদ মেয়র পারিষদ (স্বাস্থ্য) অতীন ঘোষই হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলেন। অভিযোগ, সদ্য বিদেশ থেকে আসা ওই ব্যক্তি বহুতলে তাঁর ফ্ল্যাটের বারান্দায় দাঁড়িয়েছিলেন। ‘‘উনি নিজের বারান্দায় দাঁড়ালে কী সমস্যা? করোনা আক্রান্ত কারও সঙ্গেও তিন মিটার দূরত্ব থাকলে দুশ্চিন্তা নেই। ২০ ফুট উঁচু বারান্দা থেকে কেউ কী ভাবে ভাইরাস ছড়াবেন?’’— বলছেন অতীন।

খামোখা আতঙ্ক এবং অজানা ভয়ের মধ্যে কিন্তু ফারাক আছে। বিদেশ-ফেরত কাউকে নিয়ে আবাসনে বা ফ্ল্যাটে কী ভাবে সাবধানে থাকা যাবে, তা নিয়ে ধোঁয়াশায় অনেকেই। সাংসদ-নায়িকা মিমি চক্রবর্তীও ইতিমধ্যে জানিয়েছেন, বাড়ির ভিতরে অন্য সকলের সঙ্গে দূরত্ব রেখে একটি ঘরে কী ভাবে তিনি দিন কাটাচ্ছেন। বালিগঞ্জের করোনাগ্রস্ত তরুণের বাড়ির উল্টো দিকের বাসিন্দা এক সমাজকর্মী আবার বলছিলেন, ‘‘আমার পরিচারিকার দিদি ওই বহুতলে কাজ করেন। আমি তাই ধন্দে, বাড়ি থেকে বেরোনো কতটা ঠিক হচ্ছে।’’

সাদার্ন অ্যাভিনিউয়ের বাসিন্দা যে পুরকর্তার বিরুদ্ধে ঝুঁকিপূর্ণ আচরণের অভিযোগ উঠেছে, তিনি কিন্তু অনড়। ‘‘আমি সমস্ত নিয়ম অক্ষরে অক্ষরে মানছি। কে বলেছে, বাড়িতে বিদেশ-ফেরত কেউ থাকলে আমি বেরোতে পারব না?’’ স্থানীয় কাউন্সিলর বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় থেকে মেয়র পারিষদ অতীন ঘোষ অবশ্য মনে করেন, কারও বাড়িতে বিদেশ থেকে কেউ এলে তাঁর সংস্পর্শে থাকা বাকিদেরও ১৪ দিন বাড়িতে বিচ্ছিন্ন থাকাটাই উচিত।

ওই বহুতলটির অ্যাসোসিয়েশনের এক কর্তা বলছেন, ‘‘বিভিন্ন ফ্ল্যাটে অনেক বয়স্ক বা অসুস্থ লোকজন আছেন। কয়েকটি সদ্যোজাত শিশুও রয়েছে। ওই পুরকর্তা ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়েছেন, সিসি ক্যামেরায় তার প্রমাণ রয়েছে। ওঁর ভয়ে আমরাই বেরোতে পারছি না।’’ তবে ওই বহুতলের বাসিন্দাদের দাবি, যে কোনও আবাসিকের সঙ্গেই সঙ্কটে সহযোগিতা করতে তাঁরা প্রস্তুত। যেমন, শনিবার মধ্যরাতে অস্ট্রেলিয়া থেকে এক প্রবীণ দম্পতি তাঁদের ফ্ল্যাটে ফিরেছেন। এর আগে তাঁদের জামাই ফ্ল্যাট সাফসুতরো করে খাবার ও প্রয়োজনীয় সামগ্রী রেখে আসেন। সকলের স্বার্থেই বহিরাগতদের সঙ্গে সংস্রব বন্ধ রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে যে কোনও দরকারে ইন্টারকমে যোগাযোগের অনুরোধ করে রেখেছেন প্রতিবেশীরা।

প্রতিবেশীদের মধ্যে এই বিচ্ছিন্নতাই যে সমাজের সবার স্বার্থে শ্রেয়, সেটাই বারবার বলছেন, হৃদ্‌রোগ চিকিৎসক কুণাল সরকার বা ক্যানসার চিকিৎসক সুবীর গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁদের মতে, ‘‘এখনও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে সংক্রমণ থেকে অনেকটাই ঠেকিয়ে রাখা গিয়েছে। এ দেশে নিম্নবিত্ত শ্রেণির মধ্যে ছোঁয়াচে রোগটা ছড়ালে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবনযাপন আরও কঠিন হবে।’’

জনস্বাস্থ্য বিষয়ক চিকিৎসকেদের মতে, ‘‘গৃহবন্দি অবস্থায় কে কতটা স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করছেন, তার নজরদারিও দরকার।’’ মেয়র পারিষদ অতীনবাবু অবশ্য বলছেন, ‘‘শহরে ছ’-সাত হাজার লোক কয়েক দিনে বিদেশ থেকে ফিরেছেন। সকলের বাড়িতে স্বাস্থ্যকর্মী পাঠানো সোজা নয়। নিজেদের সচেতনতার বিকল্প নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন