ট্রাক ধর্মঘটের জেরে বাজারে উধাও ডিম ও মাছ

বাজারে গিয়ে মাথায় হাত গড়িয়ার মহেন্দ্র চৌধুরীর। বাড়িতে কাতলা কাটা ছাড়া চলে না। রবিবার তবু দু’একটা দোকানে মাছ মিলেছিল। কিন্তু সোমবার নিজের বাজার তো দূরস্থান, আশপাশের দু’টি বাজার ঘুরেও অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আসা রুই-কাতলা খুঁজে পেলেন না তিনি।

Advertisement

দেবাশিস দাস ও সৌভিক চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৬ অক্টোবর ২০১৫ ০৩:৩৩
Share:

বাজারে গিয়ে মাথায় হাত গড়িয়ার মহেন্দ্র চৌধুরীর। বাড়িতে কাতলা কাটা ছাড়া চলে না। রবিবার তবু দু’একটা দোকানে মাছ মিলেছিল। কিন্তু সোমবার নিজের বাজার তো দূরস্থান, আশপাশের দু’টি বাজার ঘুরেও অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে আসা রুই-কাতলা খুঁজে পেলেন না তিনি। শেষে বাঘা যতীন বাজারে গিয়ে ৩৫০ টাকা কেজির ‘লোকাল’ কাতলা কাটা কিনতে হল। কেজি প্রতি ৮০ টাকা গচ্চা গেল মহেন্দ্রবাবুর।

Advertisement

মানিকতলা বাজারে এ দোকান-সে দোকান ঘুরছিলেন আমহার্স্ট স্ট্রিটের জনক দত্ত। তাঁর এক ডজন ডিম চাই। গিন্নির হুকুম। পাড়ার দোকান ছেড়ে মানিকতলা বাজারে এসেছেন ওই অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কেরানি। কিন্তু কোথায় ডিম! বাজার থেকে ভোজবাজির মতো হঠাৎ উবে গিয়েছে। শেষ পর্যন্ত পাড়ার দোকানেই ফিরে এলেন জনকবাবু। সেখানে তখন ডিম নিয়ে কাড়াকাড়ি। সাকুল্যে চারটি ডিম নিয়ে বাড়ি। গিন্নিকে বললেন, ‘‘এটাই শেষ। সাপ্লাই নেই। কাল থেকে আর ডিমও পাওয়া যাবে কি না সন্দেহ।’’

কেন এই অবস্থা? পাতিপুকুর পাইকারি মাছ বাজারের সম্পাদক কমল দাস বলছেন, ‘‘ওড়িশায় ট্রাক ধর্মঘটের জন্য অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে ট্রাক আসা অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। ফলে মাছের জোগানও কমে গিয়েছে। কিছু বাজারের চাহিদা মেটাতে পারলেও, সবাইকে মাছ তেমন দিতে পারছি কোথায়?’’ কমলবাবুর দেওয়া হিসেব মতো ওই পাইকারি বাজারে রোজ ১৪-১৫টি মাছবোঝাই ট্রাক আসে। তাতে থাকে সব মিলিয়ে সাড়ে ৮-৯ হাজার কেজি মাছ। রবিবার সেখানে ট্রাক এসেছে ৫-৬টি। পাতিপুকুর মাছ বাজারেরই ব্যবসায়ী উত্তম হাজরা বলেন, ‘‘রবিবার যদিও বা পাঁচ থেকে ছ’টি ট্রাক অন্ধ্রপ্রদেশ থেকে মাছ নিয়ে এসেছিল, সোমবার ট্রাক ঢোকেনি। শুধু অন্ধ্রপ্রদেশের রুই-কাতলাই নয়, ওড়িশার পার্শে, ভেটকি, গুরজালি, ভোলার জোগানও আপাতত বন্ধ।’’

Advertisement

সল্টলেকের এফ ডি বাজারের মাছ ব্যবসায়ী কৃষ্ণ মাঝি বলেন, ‘‘যে মাছটা তিন দিন আগে ২২০ টাকা দরে বেচেছি, সেটাই এ দিন ২৮০ টাকায় বিক্রি করতে হচ্ছে।’’ দমদমের গোরাবাজারের আর এক মাছ ব্যবসায়ী আনন্দ সাহা জানাচ্ছেন, অন্ধ্রপ্রদেশের রুই-কাতলার অভাবে খুচরো বাজারে কাটা কাতলার দাম কেজি প্রতি ৫০ টাকা বেড়েছে। দু’দিন আগে যে মাছ তাঁরা কেজি প্রতি ২৫০ টাকায় বিক্রি করেছেন, তা সোমবার বিক্রি করতে হয়েছে ৩০০ টাকায়। আনন্দবাবুর কথায়, ‘‘এ দিন তা-ও পুরনো মাছ কিছু স্টকে ছিল। মঙ্গলবার থেকে কী করব জানি না।’’ গড়িয়াহাট বাজারের মাছ ব্যবাসায়ী রাজু মণ্ডল বলেন, ‘‘এখনও মজুত মাছ দিয়ে কাজ চলছে। তবে দু’এক দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি নাগালের বাইরে চলে যাবে।’’

মাছের মতোই মানিকতলা বাজারে এ দিন কোনও ডিমের দোকানে ডিম ছিল না। ডিম বিক্রেতা বাবু দে বলেন, ‘‘তিন দিন ধরে ডিমের গাড়ি আসেনি। তাই এই হাল।’’ শিয়ালদহের ডিমপট্টিতে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, প্রতিদিন অন্ধ্রপ্রদেশে থেকে সেখানে আসে ১৪ থেকে ১৫ ট্রাক ডিম। প্রতিটি ট্রাকে থাকে ১১০০ পেটি ডিম। প্রতিটি পেটিতে ২০৪টি করে ডিম ধরলে প্রতি ট্রাকে ২ লক্ষ ২৪ হাজার ৪০০ ডিম আসে ডিমপট্টিতে। অর্থাৎ ১৫টি ট্রাক রোজ আনে ৩৩ লক্ষ ৬৬ হাজার ডিম। সে জায়গায় শনিবার ডিমপট্টিতে এসেছিল মাত্র পাঁচটি ট্রাক। রবিবার ও সোমবার একটি ট্রাকও আসেনি।

শুধু মাছ আর ডিম-ই নয়, ট্রাক ধর্মঘটের জন্য ঝাড়খণ্ড থেকে আসা সব্জির জোগানেও টান। মানিকতলা বাজারের সব্জি ব্যবসায়ী গণেশ সাহা বলেন, ‘‘কোনও ট্রাক আসছে না। তাই সব্জি সরবরাহেও টান পড়েছে।’’ পাইকারি বাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন, ওড়িশা-পশ্চিমবঙ্গ সীমানায় ডিম, মাছ, সব্জি বোঝাই হাজারেরও বেশি গাড়ি বৃহস্পতিবার থেকে দাঁড়িয়ে। ট্রাক দাঁড়িয়ে ঝাড়খণ্ড সীমানাতেও।

কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে? ট্রাক ধর্মঘটের আহ্বায়ক অল ইন্ডিয়া মোটর ট্রান্সপোর্ট কংগ্রেস জানাচ্ছে, টোল ট্যাক্স আদায়ের ক্ষেত্রে জুলুমবাজি হচ্ছে সারা দেশ জুড়ে। তাঁর প্রতিবাদেই এই ধর্মঘট। সংগঠনের পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধি রাজা রায় বলেন, ‘‘আমাদের দাবি না মানা হলে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট চলবে।’’ তবে রাজ্যের ফেডারেশন অব ওয়েস্ট বেঙ্গল ট্রাক অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন এই ধমর্ঘটকে নৈতিক ভাবে সমর্থন জানালেও সরাসরি তাতে অংশগ্রহণ করেনি। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুভাষচন্দ্র বসু অবশ্য বলেছেন, ‘‘রাজ্য জুড়ে যে ভাবে আমাদের উপরে পুলিশের জুলুমবাজি হচ্ছে, তাতে আমরাও বসে থাকব না।’’

খুচরো ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, সারা দেশের সঙ্গে রাজ্যের ট্রাক সংগঠন এই ধর্মঘটে সামিল হলে পরিস্থিতি জটিলতর হবে। গড়িয়াহাট বাজারের ব্যবসায়ী মনোরঞ্জন সাহা বলেন, ‘‘এখন দু’এক গাড়ি পণ্য আসছে। এর সঙ্গে রাজ্যের ট্রাকচালকেরা যুক্ত হলে এক বস্তা আনাজও মিলবে না।’’ পরিস্থিতি মোকাবিলায় রাজ্য সরকার কড়া নজরদারি চালাচ্ছে বলে কৃষি বিপণন মন্ত্রী অরূপ রায় দাবি করেছেন।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন