খদ্দেরের অপেক্ষায়। বৃহস্পতিবার সকালে, মানিকতলা বাজার। — স্বাতী চক্রবর্তী
বৃহস্পতিবার সকাল ৯টা। দমদমের নাগেরবাজার।
জ্যান্ত গলদা, প্রমাণ মাপের ট্যাংরা আর কানা উঁচু টিনের ট্রেতে জল ঢেলে রুই-কাতলা নিয়ে দোকান সাজিয়েছেন নুর। মাছ এসেছে বসিরহাট থেকে। গলদা, একটু ছোট ৫০০ টাকা প্রতি কেজি। বড়টা ৬০০। ট্যাংরা বিকোচ্ছে ৫০০ টাকায়। জ্যান্ত রুই ২০০। কাতলা গোটা ২৪০। এক কেজির আশপাশে ওজন। ছোট-বড় মিলিয়ে ওই দোকানির কাছে গলদা ছিল পাঁচ কেজির মতো। ট্যাংরা কেজি দুয়েক। আর রুই-কাতলা গোটা ১১।
বেলা ১০টা। নুরের কাছে গিয়ে দেখা গেল, গলদা প্রায় নেই। গোটা চারেক রুই-কাতলা পড়ে আছে ট্রে-তে। আর ট্যাংরা প্রায় তলানিতে।
মানুষের হাতে টাকা নেই। তবু এত তাড়াতাড়ি বিক্রি হয়ে গেল মাছ? নুর হাসেন, ‘‘মানুষ নিচ্ছে বলেই তো আমরা আনছি। মাঝখানে ক’দিন তো মাছ আনা প্রায় বন্ধই করে দিয়েছিলাম। মাছের দামও কিছুটা নেমে গিয়েছিল। এখন দেখছি মানুষের হাতে ফের টাকা এসেছে। এ দিকে, সাপ্লাই তেমন নেই। মাছের দামও তাই চড়ছে।’’
বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ১০টা। বাঁশদ্রোণী সুপার মার্কেটে বাবু দাসের মাছের দোকান। বড় ডালায় সাজানো ছোট সাইজের গলদা চিংড়ি। ৫৫০ টাকা কেজি। ওই চিংড়ি ৩০০ টাকার নেবেন জানিয়ে এক গৃহবধূর আবদার, ‘‘আমার কাছে ২০০০ টাকার নোট। ভাঙিয়ে দিতে হবে কিন্তু।’’ বাবু দাস রাজি। ৫৫০ টাকা দরে ৩০০ টাকার গলদা কিনে নিয়ে গেলেন ওই মহিলা।
দাম বাড়লেও কোনও জিনিসের বিক্রি না কমলে তার অর্থ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা রয়েছে। মানুষ কিনছেন বলেই ব্যবসায়ীরা মাছ আনছেন। না হলে তো মাছ পচেই যেত। শুধু মাছ নয়, সব্জি কিংবা চাল-ডালের ক্ষেত্রেও এক নিয়ম। গত ৮ নভেম্বর হঠাৎই ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বাতিল ঘোষণার পরে দিন দশেক বাজার থেকে প্রায় কর্পূরের মতো উবে গিয়েছিলেন ক্রেতারা। তবু পাইকারি মাছ থেকে সব্জি— সব বাজারই খোলা ছিল, পসরা নিয়ে বসেছিলেন খুচরো বাজারের দোকানিরাও। কিন্তু বিক্রিবাটা ছিল অনেক কম। দাম কিন্তু তেমন কমেনি। বরং তিন-চার দিনে চন্দ্রমুখী আলুর দাম কেজি প্রতি ৩০ টাকা হয়েছে। দাম বেড়েছে ঝিঙে, পটল, বেগুন, ভেন্ডিরও। নভেম্বরের শীতেও ১০ টাকায় ভাল ফুলকপি বা বাঁধাকপি চোখে দেখা যাচ্ছে না।
মাছের দাম বাড়ার পিছনে মাছ ব্যবসায়ীদের অনেকেই বিয়ের মরসুমের যুক্তি দিচ্ছেন। মানিকতলার এক মাছ ব্যবসায়ীর দাবি— বিয়ের বাজার এবং নগদের অভাব, দুয়ের জেরেই দাম বাড়ছে। আর এক মাছ ব্যবসায়ী বলছেন, বড় মাছের সরবরাহ কিছুটা কমেছে। ফলে গত তিন-চার দিনে দাম বেড়েছে রুই-কাতলার। মাছ ব্যবসায়ী ঝন্টু সোনকার জানান, যে গোটা কাতলা দিন কয়েক আগে কেজি প্রতি ২০০-২২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল, তার দাম এখন ২৭০ টাকায় গিয়ে ঠেকেছে। দাম বেড়েছে গলদারও।
জ্যান্ত মাছ আসা কমেছে মাছ ব্যবসায়ী গোপাল হালদারের কাছে। তিনি বলেন, ‘‘জেলেরা আগে দিনের দিন দাম পেয়ে যেতেন। এখন তা না পেয়ে মাছ কম তুলছেন। ফলে বাজারে ছোট-বড় সব ধরনের মাছের জোগানই কমে গিয়েছে। স্বাভাবিক নিয়ম মেনেই তাই দাম বেড়েছে মাছের।’’ গড়িয়াহাটের এক মাছ ব্যবসায়ীর মন্তব্য, ‘‘আড়তদারেরা যে সব জেলের কাছ থেকে মাছ কেনেন, তাঁদের বেশির ভাগেরই ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট নেই। নগদ টাকা ছাড়া এই ব্যবসা চালানো সম্ভব নয়। এত দিন ৫০০-১০০০ টাকা চলেছে। এ বার কী হবে?’’
মাছ ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, ‘‘টাকার জোগান ঠিকঠাক হলে দেখতেন বাজারে মাছ উপচে পড়ছে। বেশি করে পাঁচশো টাকার নোট বাজারে আসতে হবে। তা না হলে কিন্তু দাম আরও বাড়বে। কারণ এ ভাবে চলতে থাকলে মানুষের কেনার পরিমাণ আরও কমবে। আমাদের আরও বেশি দামে মাছ আনতে হবে।’’ একই আশঙ্কা বাঁশদ্রোণী সুপার মার্কেটের এক মাছ ব্যবসায়ীরও। বললেন, ‘‘সকাল থেকে এই নিয়ে সাত জনকে ২০০০ টাকার নোট ১০০ টাকায় ভাঙিয়ে দিতে হল। সকলেই ২০০-৩০০, বড়জোর ৪০০ টাকার বাজার করেছেন। ২০০০ টাকার মাছ বেচে ৬০০ টাকার খুচরো দিতে হচ্ছে ১০০-র নোটে। এ ভাবে চালানো সম্ভব?’’ আর এই সম্ভব না হওয়ার সবচেয়ে বড় কারণ— পাঁচশোর নোটের দেখা নেই বাজারে।
নোট-কাণ্ডের জেরে জাতীয় অর্থনীতি যখন টালমাটাল, তখন কিন্তু কলকাতার বাজারগুলিতে ‘শীতের মাছ’ ভাঙন, আড়, নতুন কই চলে এসেছে। বিক্রিও হচ্ছে। তবে ক্রেতারা নিচ্ছেন কম করেই। লেক মার্কেট বাজারের এক মাছ ব্যবসায়ীর কথায়, ‘‘মাছ তো আনতেই হবে। ধারে আনছি। ধারে দিচ্ছি। এই ধার-বাকির কারবারে দাম তো বাড়বেই।’’ আজ, শুক্রবার মরসুমের দ্বিতীয় বিয়ের তারিখ। ফলে, কাটা পোনা, পাবদা ও ভেটকি মাছের দাম কমার লক্ষণ নেই। পাঁচ-ছ’কেজি ওজনের কাতলা মাছ কাটা বিক্রি হচ্ছে ৪৫০ টাকা কেজি দরে, পাবদা কেজিতে ৬০০ টাকার এক পয়সাও কম নিতে নারাজ ব্যবসায়ীরা। গোটা ভেটকির ওজন এক কেজির বেশি হলে ৪৫০ টাকা আর দু’কেজির বেশি হলে ৫০০ টাকা প্রতি কেজিতে।
মাছের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে চন্দ্রমুখী আলুর। মানিকতলার আলু বিক্রেতা বাবু পাল জানান, চন্দ্রমুখী আলু তিন দিনে ২৫ টাকা থেকে বেড়ে ২৮ টাকা হয়ে গিয়েছে। সব্জি বিক্রেতা রাম সোনকারের সমস্যা ভিন্ন। তিনি জানান, ক্রেতার সংখ্যা কমতির দিকে। পুরনো নোট তো নিচ্ছেনই না, এমনকী অনেকে ১০০-১২০ টাকার সব্জি কিনতে দু’হাজারেরা দিচ্ছেন। রামের কথায়, ‘‘১০০ টাকার জোগান এত কম যে, নতুন ৫০০ টাকার নোট দিয়েও কেউ ১২০ টাকা সব্জি কিনতে চাইলে আমি বাকি টাকা ফেরত দিতে পারছি না।’’ অথচ শীতের সব্জি উঠতে শুরু করেছে। তার জোগান বেড়ে গেলে বাজারের কী হাল হবে, চিন্তিত পাইকার ও খুচরো বিক্রেতারা।