Kolkata

প্রকৃতির সঙ্গে আমরা নিবিড় ভাবে জড়িয়ে ছিলাম

আমার জন্ম দক্ষিণ কলকাতায়। সবার সঙ্গে যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছি। এই সাপোর্ট সিস্টেমটা অসাধারণ ছিল। আমার ছোট বেলায় পাড়া কালচারটা দেখেছি। বাবা খুব সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই পাড়ায় বাচ্চাদের নিয়ে নানান অনুষ্ঠান করা, এ সব তো ছিলই।

Advertisement

ডলি বসু (নাট্য নির্দেশক ও অভিনেত্রী)

শেষ আপডেট: ২১ ডিসেম্বর ২০১৬ ১৪:২৭
Share:

আমার জন্ম দক্ষিণ কলকাতায়। সবার সঙ্গে যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠেছি। এই সাপোর্ট সিস্টেমটা অসাধারণ ছিল। আমার ছোট বেলায় পাড়া কালচারটা দেখেছি। বাবা খুব সংস্কৃতি মনস্ক মানুষ ছিলেন। ছোট বেলা থেকেই পাড়ায় বাচ্চাদের নিয়ে নানান অনুষ্ঠান করা, এ সব তো ছিলই। মায়ের শাড়ি, বাড়ির বেড কভার নিয়ে এসে স্টেজ বানিয়ে পারফর্ম করা। বেশ ছিল সে সব দিন। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। এক বার অনুষ্ঠানের জন্য একটা শাড়ি কম পড়ায় মায়ের অনুমতি ছাড়াই বাবা একটা শাড়ি এনে আমাদের দিয়েছিল। এই ঘটনায় মা চার দিন বাবার সঙ্গে কথা বলেনি। আমারা মা ছিলেন মুভি বাফ। তখন বাবা আর কী করবে! যদিও বাবা হিন্দি ছবি দেখতে একেবারেই পছন্দ করতেন না। অগত্যা মায়ের সঙ্গে ভাব করার জন্য, প্রিয়া সিনেমা থেকে হিন্দি ছবির দুটো টিকিট কেটে আনেন। একটা রোম্যান্টিক আউটিংও হয়ে গেল।

Advertisement

বাবা পাড়ার সব বাচ্চা এবং আমাকে নিয়ে সকালে লেকে হাঁটতে যেতেন। সুইমিং করতাম। সে সময় ভোর সাড়ে পাঁচটাতেই মুদির দোকানগুলো খুলে যেত। তখন ললিপপ, ভেসেল পপ পাওয়া যেত। সেই পেয়ে আমাদের যে কী আনন্দ! বৃষ্টি হলেই বাবা আমাদেরকে লেকে নিয়ে যেতেন। তখনকার দিনে ছাতা, রেইনকোট আর গামবুট ছিল আমাদের ফ্যাশন স্টেটমেন্ট। এগুলোই বিশাল ব্যাপার ছিল। তখন খোঁজ নেওয়া হত, কোথায় কোথায় বৃষ্টির জল জমেছে। সেই জলের মধ্যে নৌকো ভাসানো, জল প্লাশ করা — এ সবেই ছিল আমাদের আনন্দ।

আরও পড়ুন, লিউকেমিয়ার সঙ্গে যুদ্ধ করেই মা হলেন তরুণী

Advertisement

সপরিবার। ছবি: লেখকের সৌজন্যে।

কলকাতার তিনটি জিনিস ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ আমার কাছে। নিরাপত্তা বোধ, সৌন্দর্য এবং পাড়া কালচার। সুখে-দুঃখে-আনন্দে দারুণ ভাবে জড়িয়ে থাকতাম পাড়ার সকলের সঙ্গে। আমরা যে কী লাকি ছিলাম, বলে বোঝাতে পারব না! প্রত্যেক শীতে লেকে বসে, সারাদিন ধরে যাযাবর পাখিগুলোকে দেখতাম। আসলে প্রকৃতির খুব কাছাকাছি ছিলাম আমরা। ছোটবেলায় আমরা তিনটে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে গেছি। চিন-যুদ্ধ, পাকিস্তান-যুদ্ধ এবং বাংলাদেশ মুক্তি-যুদ্ধ। প্রায়ই ব্ল্যাকআউট হয়ে যেত।

বাবা যখন মারা যান, আমার বয়স মাত্র ষোলো বছর। আমার দাদা চলে গেলেন শিপইয়ার্ডে। আমার মতো একটা বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে মা থাকতেন। তবুও ভয় কাকে বলে জানতামই না। আমি মায়ের কাছে ওয়েল প্রোটেকটেড ছিলাম। যেটা এখন ভীষণ মিস করি। তবে আমি যা হতে পেরেছি, সবটাই আমারা বাবার অবদান। বাবা সমস্ত ভাবে, সব কিছুতে উৎসাহ দিতেন। ভাল-মন্দ বোঝাতেন। তবে বাবা চলে যাওয়াতে কেমন যেন খুব তাড়াতাড়িই বড় হয়ে গেলাম। এই পরিস্থিতিতে যা হয় আর কী। অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে গেল। ছেলে-মেয়ে হল। স্বাভাবিক ভাবেই জীবনটা দ্রুত বদলে যেতে লাগল! সেই সঙ্গে কলকাতা শহরেও পরিবর্তন আসতে শুরু করল, ভাল-মন্দ মিশিয়ে। নাইট ক্লাব, ডানসিং বার, ডিস্কো কালচারের সঙ্গে পরিচিত হতে থাকল কলকাতা।

কলকাতা শহরে এক সময় বন্ধুত্ব শুধুমাত্র বন্ধুত্বের জন্যই হত। কিছু পাব বলে মেলামেশা নয়। কার কেমন বাড়ি, ক’টা গাড়ি আছে, তোমার বাড়ির ঠিকানা কোথায় — এগুলো কিন্তু বড় বিষয় ছিল না, বন্ধুত্বে। আমার বিশ্বাস আজকের কলকাতাতেও খাঁটি বন্ধুত্ব আছে। বন্ধুত্ব মানেই তাদের সঙ্গে আমার একটা মানসিক মিল আছে। তাদের সঙ্গে খুব আড্ডা মারব, খাবদাব, খুব মজা করব এ সব। তবে মানুষের মেলামেশায় এখন কিছুটা হলেও পরিবর্তন এসেছে, স্বার্থ মিশেছে। তবুও বলব, চরিত্রে এ শহর অন্য শহরের থেকে আলাদা ছিল। আমার মতে বন্ধুত্ব এ শহরের প্রধান বৈশিষ্ট। আড্ডা-কালচার, এটাই কলকাতার আত্মা।

এই পরিবর্তন শুধু কলকাতা শহরেই নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই হচ্ছে। তাই কলকাতা আলাদা কিছু নয়। এ শহরের যেটা দেখে আমার ভীষণ কষ্ট হয়, যখন শুনি একটা মহিলাকে পিটিয়ে দিল! মহিলাদের সঙ্গে চরম দুর্ব্যবহার দেখছি। আমি রেপের কথা তো ছেড়েই দিচ্ছি। ভাবতে অবাক লাগে, এই কলকাতাতেই আমরা মাথা উঁচু করে ঘুরতাম। এটাই আমার অহঙ্কার ছিল। যেটা এখন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। নারী নির্যাতন, নারী নিগ্রহ যা যা হচ্ছে, ভাবা যায় না! এখন যে ব্যবহার মেয়েরা পায়, আমি ভাবিইনি কোনও দিন।

কলকাতায় যেখানে এত ঘটা করে দুর্গাপুজো, কালীপুজো আরও সমস্ত রকমের পুজো হয়—আজকে সেখানে মেয়েরা ভয়ে থাকবে কেন? মেয়েরা ছুটিতে আমার কাছে বেড়াতে এলে, যতক্ষণ না তারা ঠিকমতো বাড়িতে ফিরছে, আমি স্বস্তিতে থাকতে পারি না। এটাই কি তবে আমার চেনা কলকাতা?

একান্তে।

আবার এটাও দেখছি, রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্টে মানুষ পড়ে আছে। মারা যাচ্ছে, কেউ ধারেকাছে আসছে না! তার পর অন্যান্য সমস্যা তো আছেই। ট্রাফিক সংক্রান্ত, পলিউশন নিয়ে। দিনের পর দিন মুড়ি-মুড়কির মতো মানুষের অ্যাক্সিডেন্ট হয়। শুধুমাত্র অসতর্কতায়, কত মানুষ প্রাণ হারায়। যাদের সামান্য বোধগম্যি নেই, নিয়মকানুনের ধার ধারে না! চোখের সামনে দেখি, পুলিশই কালো ধোঁয়ার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। এই তো, কিছু দিন আগের ঘটনা। এক পার্কিং জোনে পুলিশ নিয়ম মেনে গাড়ি না রাখায় প্রতিবাদ করি। বলে, ‘আপনি কে? আমি পুলিশ, আপনি কী বলবেন?’ এই ঔদ্ধত্য, দম্ভ! আমি ভাবতেই পারি না, এই আস্পর্ধা আসে কোথা থেকে? নিয়ম ভাঙাটাই মজ্জায় ঢুকে গেছে আমাদের। পলিউশন নিয়েও আমাদের ভাবতেই হবে। আমাদের নয় বয়স হয়েছে, চলে যাব। কিন্তু ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য কী ভয়ঙ্কর দিন অপেক্ষা করছে!

আমি তো এই শহরের প্রকৃতির মধ্যেই বড় হয়েছি। তাই খুব খারাপ লাগে যখন দেখি হেরিটেজগুলোর সঠিক সংরক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ হচ্ছে না। যখন দেশ-বিদেশে বেড়াতে যাই দেখি, ওদের ঐতিহ্যকে ওরা কী ভাবে পরম যত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছে। আমরা হেরিটেজগুলোকে ক্রমশ হারিয়ে ফেলছি। তবে সংরক্ষণের কিছু চেষ্টা হচ্ছে। গঙ্গার ধার বাঁধানো হয়েছে, অনেক ফ্লাইওভার তৈরি হচ্ছে। আমার সল্টলেকের পার্কগুলো খুব সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। যেখানে নাতি-নাতনিদের খেলতে নিয়ে যেতে পারি।

কাজের জায়গায়ও একই অভিজ্ঞতা। আমাদের প্রজন্মের সঙ্গে এই প্রজন্মের অনেক ফারাক। ‘স্লো বাট স্টেডি’ এই নীতিতে আমরা বিশ্বাসী ছিলাম। কিন্তু এই প্রজন্মের অনেকের মধ্যেই দেখি, শেখার ইচ্ছেটা খুব কম। সহজেই প্রশংসা পেতে চায়। কোনও কিছুর গভীরে যেতে চায় না! বড়দের সঙ্গে তর্ক করে। তবে বয়স অনুযায়ী ওরা অনেক বেশি স্মার্ট।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন