মুখ ঢেকেছে আবর্জনায়। সোমবার। — দেবস্মিতা ভট্টাচার্য
ময়দান তুমি কার?
বড়দিন, বর্ষপূর্তি আর বর্ষবরণের লাগাতার উৎসব-মরসুম পেরোনোর পরে কলকাতা ময়দান যে ভয়ঙ্কর রকম নোংরা হয়েছে, তাতে এ প্রশ্নটাই উঠে এসেছে। পুর-পরিষেবা দেওয়ার দায় যাঁদের, তাঁরা বলছেন ময়দানের মালিকানা সেনাবাহিনীর। তাই সাফ করার দায়িত্বও তাদের। আবার সেনার পাল্টা বক্তব্য, সাধারণ মানুষ ময়দান নোংরা করলে তা পরিষ্কার করা পুরসভারই দায়িত্ব। ময়দান পরিষ্কার করার জন্য সেনার আলাদা লোক নেই।
পুরসভা ও সেনাবাহিনীর এই চাপান-উতোরের মধ্যেই আরও একটি বিষয় প্রকট হচ্ছে। শহর দেখেছে, যে কোনও রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ হলে অনুষ্ঠানের পরপরই ময়দান সাফ করতে কোমর বেঁধে নেমে পড়েন সংশ্লিষ্ট দলের নেতা-কর্মীরা। ঝাঁটা হাতে সামনে থেকে ‘নাম কেনেন’ তাঁরা। কিন্তু উৎসব-পার্বণ পরবর্তী অপরিচ্ছন্ন ময়দানের জন্য তো কোনও রাজনৈতিক দলেরই মাথাব্যথা নেই! এমনকী পুর-পরিষেবা দেওয়ার জন্য যে দলের বের্ড ক্ষমতায় আছে, সাফ না করার পক্ষে যুক্তি খোঁজে তারাও।
সোমবার ময়দান চত্বরে গিয়ে দেখা গেল মাঠ জুড়ে উড়ছে কালো পলিথিন। পায়ে পায়ে ঘুরছে প্লাস্টিকের চ্যাপটানো বোতল। চায়ের প্লাস্টিক-কাপ, ঝালমুড়ির কাগজের প্লেট, খবরের কাগজ তো আছেই। উল্লেখযোগ্য ভাবে পড়ে রয়েছে রাশি রাশি শোলার থালা-বাটি। ডাস্টবিন যে ক’টা আছে, সবই ময়দানের বাইরে। যাঁরা ভিতরে রয়েছেন, তাঁরা কেউ দীর্ঘ পথ পেরিয়ে প্লেট ফেলতে যেতে রাজি নন। ফলে প্রতি দিন জমছে আবর্জনা। ভিক্টোরিয়ার দিকে যে ফোয়ারা, বা তার বাঁ পাশে রাখা দু’টি কামান— এই জায়গাগুলোয় থিকথিক করছে প্লাস্টিক-শোলা-কাগজের টুকরো। সেগুলিই হাওয়ায় উড়ছে, অথবা কাক ও কুকুরের মুখে মুখে ছড়াচ্ছে এ দিক-সে দিক। সেই জঞ্জালে ভরা ময়দানেই শহর মেতেছে আনন্দে।
ময়দানের এই হাল ঘোচাতে কে ব্যবস্থা নেবে, তা নিয়ে প্রশ্নে মেয়র শোভন চট্টোপাধ্যায়ের স্পষ্ট দাবি, প্রশাসনিক ভাবে ময়দানের মালিকানা যেহেতু সেনার, তাই ময়দানের পরিচ্ছন্নতার দায়িত্বও সেনার। তাঁর অভিযোগ, ‘‘ময়দানে একটি আলপিন পুঁততেও সেনার অনুমতি লাগে। তাই পুরসভার তরফে ইচ্ছেমতো ডাস্টবিন বসানো যায় না। শুধু ময়দান কেন, আরও বহু ক্ষেত্রেই সৌন্দর্যায়নের টাকা এসেও ফিরে যায়। সবই শুধু সেনার গা-ছাড়া মনোভাবের কারণে।’’
রাজ্য দূষণ নিয়ন্ত্রণ পর্ষদের প্রাক্তন মুখ্য আইন আধিকারিক বিশ্বজিৎ মুখোপাধ্যায় অবশ্য জানিয়ে দিলেন, ‘‘আইন বলছে ময়দানের মালিকানা সেনার হলেও তার দেখভালের দায়িত্ব পুরসভারই। শুধু ময়দান কেন, শহরের সমস্ত জঞ্জালই পুরসভার সাফ করার কথা।’’ মেয়রের পাল্টা যুক্তি, ‘‘যেহেতু ময়দান সেনার সম্পত্তি, তাই পুরসভার কাছে পরিচ্ছন্নতার কথা জানানোও সেনার কাজ।’’ এক সেনাকর্তার বক্তব্য, ‘‘মালিকানা সেনার হলেও ময়দান ব্যবহার করছে সারা শহরের আমজনতা। স্বভাবতই সেটা দেখভালের দায় পুর প্রশাসনেরই।’’
এই দায় এড়ানোর পালায় কি তা হলে দূষণের স্তূপে চাপা পড়ে থাকবে শহরের ফুসফুস? মেয়রের বক্তব্য, ‘‘শহরের ফুসফুস হিসেবে ময়দানের গুরুত্ব বুঝি বলেই নৈতিকতার দিক থেকে প্রতি বছর ময়দান পরিষ্কার করার দায়িত্ব নিই আমরা। এ বছরও কাজ শুরু হয়ে যাবে দু’-এক দিনের মধ্যেই। তবে সরকারি দায়িত্ব হিসেবে নয়, নীতিগত কর্তব্য হিসেবে।’’ এই নৈতিকতার দায় অবশ্য প্রশাসনের একার নয় বলে জানালেন পরিবেশকর্মী সুভাষ দত্ত। সেনার পক্ষে মত রেখে তিনি বলেন, ‘‘পুরসভারই দায়িত্ব নেওয়া উচিত এটা যেমন ঠিক, তেমনই সাধারণ মানুষেরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন ময়দানের পরিচ্ছন্নতার স্বার্থে।’’